20161026

নভেম্বর বিপ্লব: মানবজাতির জন্য এক নতুন দিশা

শ্রেণী শোষণ থেকে মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় মানব ইতিহাসে প্রথম অগ্রগতি হলো মহান নভেম্বর বিপ্লব। নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে শ্রমিক কৃষক ও অন্যান্য শোষিত অংশের মানুষের এটি প্রথম সফল বিপ্লব।

নভেম্বর বিপ্লব কি?
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লব বিশ্ব ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন সমাজন্ত্রিক রাষ্ট্র —— সোভিয়েত ইউনিয়ন। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লবী আন্দোলনকে তা বিশ্বের সামনে নিয়ে আসে।
রাশিয়ার এই বিপ্লব সংগঠিত হয় ১৯১৭ সালের ১৭ই নভেম্বর (প্রাচীন রাশিয়ার বর্ষপঞ্জী অনুসারে এই তারিখ ছিল ২৫শে অক্টোবর)।
জার রাজতন্ত্রের কেন্দ্র ছিল রাশিয়াএই রাজত্বের হাতে ছিল গোটা মধ্য—এশিয়াসহ বিশাল সাম্রাজ্য। জারের শাসন পদ্ধতির ভিত্তি ছিল বৃহৎ জমিদারতন্ত্র। এই সাম্রাজ্যের উৎকৃষ্ট জমির ৮০ লক্ষ হেক্টর ছিল সর্বশেষ জারের মালিকানায়। সেই সময়ে ছিল ২৮,০০০ বৃহৎ জমির মালিক যাদের হাতে ছিল ১৬.৭৪ কোটি একর জমি।
এই আধা সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি প্রথার পাশপাশি পুঁজিবাদী বিকাশ শিল্পখনি ক্ষেত্রে একচেটিয়া পুঁজির উদ্ভব ঘটায়। দ্রুততার সঙ্গে পুঁজিবাদের বিকাশ হলেও বৃহৎ ইউরোপীয় দেশগুলির পুঁজিবাদী বিকাশের তুলনায় রাশিয়া ছিল তখনও পশ্চাদপদ।
জার ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করেন। জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির উপনিবেশ ও সম্পদ দখলের প্রতিযোগিতার কারণে এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বাধে।
লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও কৃষককে জারের সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করে এই যুদ্ধে পাঠানো হয়। এই যুদ্ধে রুশ পক্ষ জার্মানির কাছে হারছিল এবং হাজার হাজার রুশ সেনা প্রাণ হারান। দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকরা জমিদারদের হুকুমে দাসদের মতো যন্ত্রণা ভোগ করছিল।



প্রথম, ফেব্রয়ারি বিপ্লব
এই পরিস্থিতিতে গণ অসন্তোষ তীব্র আকার নেয়। বিপ্লবী শক্তিগুলি বিশেষত বলশেভিক পার্টি জার রাজত্বের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান সংগঠিত করে। এই গণ অভ্যুত্থান বিপ্লবের রূপ নেয়। যা ঘটে ফেব্রুয়ারি, ১৯১৭ সালে। জার স্বৈরতন্ত্র উৎখাত হয় এবং তার জায়গায় বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রিত একটি সরকার গঠিত হয়, যেখানে কয়েকটি সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিও যোগ দেয়। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরে গঠিত অস্থায়ী সরকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির সাথে আপস করে রুশ বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার রাস্তা নেয়। যুদ্ধে বিপর্যয় এবং অসংখ্য সৈন্যের মৃত্যুর পরিস্থিতিতে এই সরকার ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারায়।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লব জনগণের হাতে ক্ষমতায় নতুন এক হাতিয়ারকে সামনে নিয়ে আসে- সোভিয়েত সমূহ। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত বড় বড় শহরে এবং গ্রামীন এলাকায় শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্যদের সোভিয়েত গড়ে ওঠে।
শ্রমিকদের সোভিয়েত এবং সৈন্যদের মধ্যে গঠিত সোভিয়েতগুলির মধ্য থেকে বলশেভিক পার্টি ( বিপ্লবের পর হয় কমিউনিস্ট পার্টি) ক্রমবর্ধমান সমর্থন পেতে থাকে। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে অস্থায়ী সরকার শ্রমিক কৃষক ও সৈন্যদের তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষের মুখোমুখি হয়। চলমান বিপ্লবকে রক্ষা করতে সর্বহারারা রাজধানী পেট্রোগ্রাড এবং মস্কোর মতো শহরে নিজেদের সোভিয়েত ও সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করে। গ্রামীন রাশিয়া জুড়ে কৃষক এবং খেতমজুররা জমিদার ও রাজন্যবর্গের জমি দখল করতে থাকে। সামরিক বাহিনীর মধ্যে সৈন্যরা নিজেদের সোভিয়েত নির্বাচিত করে যুদ্ধের অবসান ও শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি করতে থাকে। লেনিন বলেছিলেন এই সৈন্যদের বেশিরভাগটাই ‘‘ উর্দি পরিধান করা কৃষক’’

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে: সোভিয়েতগুলিকে সমস্ত ক্ষমতা প্রদানের দাবি
এই পরিস্থিতিতে বলশেভিক পার্টির নেতা লেনিন ঘোষণা করেন যে দেশ বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রথম পর্বের থেকে দ্বিতীয় পর্বের দিকে যাচ্ছে এবং ক্ষমতা দিতে হবে সর্বহারা ও কৃষকদের গরিবতম অংশের হাতে।
‘‘সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েগুলিকে দাও’’ বলশেভিক পার্টির এই ডাকে চূড়ান্তভাবে ২৫শে অক্টোবর (৭ই নভেম্বর) শ্রমিকদের সশস্ত্র অংশ (লাল ফৌজ) এবং সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিপ্লবী সেনারা অস্থায়ী সরকারকে উৎখাত করতে এগিয়ে যান। রাজধানী পেট্রোগ্রাডে ক্ষমতা দখলের মধ্যে দিয়ে বিপ্লব সফল হয়। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে প্রতিবিপ্লবী সেনাদের প্রতিরোধ ভেঙে মস্কো এবং অন্যান্য কেন্দ্রে, গোটা রাশিয়ায় এবং পুরনো জার সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে সোভিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই বিপ্লবের পরে লেনিনের নেতৃত্বে জনগণের কমিশারদের পরিষদ নিয়ে নতুন সরকার গঠিত হয়।
জমি, শান্তি ও রুটির শ্লোগানে বলশেভিকরা জনগণকে সংগঠিত করেছিল। নতুন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল শ্রমিক, সৈন্য ও কৃষকদের ডেপুটিদের সর্ব রাশিয়ান কংগ্রেস-এ জমি ও শান্তির জন্য ডিক্রি পেশ করাএই কংগ্রেসের গৃহীত জমি ডিক্রিতে গির্জা-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা জমি, তাদের গবাদি পশু ও কৃষির সরঞ্জাম ও বাড়িঘর অধিগ্রহণ করে স্থানীয় জমি কমিটি ও কৃষক ডেপুটিদের জেলা সোভিয়েতগুলির হাতে তুলে দেওয়া হয়।
যুদ্ধলিপ্ত সব সরকারগুলি ও জনগণের মধ্যে অবিলম্বে শান্তি আলোচনাসহ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ডাক দেওয়া হয় শান্তি ডিক্রিতে। ক্ষয়ক্ষতি ও এলাকাভুক্ত ছাড়াই অবিলম্বে শান্তি চুক্তি করার সংকল্প ঘোষণা করে নতুন সোভিয়েত সরকার।
অন্যান্য ডিক্রিগুলি ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, অবৈতনিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যরক্ষা এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের নতুন ইউনিয়ন গঠন সম্পর্কিত।
জারের রাশিয়া ছিল ‘‘জাতিসমূহের বন্দীশালা’’। রুশ বিপ্লব ঔপনিবেশিক জোয়াল থেকে বিভিন্ন অ-রুশ জাতি সমূহকে মুক্তি দেয় এবং ইউনিয়নের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র বিষয় হিসেবে তাদের দেয় এক স্বয়ংশাসিত ব্যবস্থা।
নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্র সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজ শুরু করার আগেই এই বিপ্লব প্রতিবিপ্লবী শক্তির আক্রমণের মুখে পড়ে। বেধে যায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। লাল ফৌজকে লড়াই করতে হয় শ্বেত ফৌজ ও প্রতিবিপ্লবীর বাহিনীর বিরুদ্ধে। ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সসহ দশটি পুঁজিবাদী দেশ প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে মদত দেয়।
চার বছরের গৃহযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লালফৌজ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ধ্বংস করে চূড়ান্ত জয়লাভ করে। এই প্রক্রিয়ায় লালফৌজকে বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে এবং লালফৌজের হাজার হাজার শ্রেণী সচেতন শ্রমিক ও কৃষক গৃহযুদ্ধে প্রাণ দেয়।

কেন এটিকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব?
পৃথিবীতে আগে যা বিপ্লব হয়েছে তার থেকে নভেম্বর বিপ্লব পৃথক। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব দিয়ে শুরু করে পূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণী ও অভিজাত শ্রেণীর কাছ থেকে বুর্জোয়াদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিভিন্ন বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে।
অতীতের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে নানা বিপ্লব হয়েছে যখন শোষকদের নতুন শ্রেণী পুরনো শোষকদের শাসনকে উৎখাত করেছিল। এটাই ঘটেছে যখন বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে বিপ্লব পূর্ণ সামন্ত শোষক শ্রেণীগুলিকে উৎখাত করেছিল।
নভেম্বর বিপ্লব তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই প্রথম শ্রমিক শ্রেণী ও তার সহযোগী শোষিত শ্রেণী গরিব কৃষকসহ মিত্ররা শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী ও শোষকশ্রেণীগুলিকে উৎখাত করতে বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে। রাশিয়াতে বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে নভেম্বর বিপ্লবকে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলা হয়। লেনিন বলেছিলেন যে, বিপ্লব তখনই সফল হয় যখন পুরনো রাষ্ট্র ক্ষমতা ভেঙ্গে নতুন ধরণের রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। রুশ বিপ্লবে তা-ই ঘটেছে। এই বিপ্লব পুরনো রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ভেঙ্গে তার জায়গায় সোভিয়েত ধরণের নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই সোভিয়েতগুলি ছিল শ্রমিক এবং গরিব কৃষক স্বার্থের প্রতিনিধি।
সমাজতন্ত্রের অর্থ উৎপাদনের উপকরণ সমূহের সামাজিকীকরণ। শিল্প, জমি ও কৃষি এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ রাষ্ট্র হাতে তুলে নিয়ে এবং যৌথ মালিকানায় নিয়ে এসে নতুন রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এই কাজ সম্পন্ন হয়। এই প্রথম পৃথিবীতে উৎপাদনের নতুন সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

বিপ্লবের সাফল্য
১৯৬০-র দশক পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি সোভিয়েত ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়। এমনকি সবচেয়ে ঘোর সমালোচকরাও এই সত্য স্বীকার করে। সম্মানিত ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসন উল্লেখ করেছিলেন: ‘‘সমস্ত বড় অথবা উন্নত দেশগুলির মধ্যে ১৯১৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে মাথা পিছু সোভিয়েত আর্থিক সমৃদ্ধি সবচেয়ে দ্রুততর, এমনকি তখনকার জাপানের চেয়েও দ্রুততর। জাপানে উৎপাদন বৃদ্ধি হয় ৪০০ শতাংশ, সোভিয়েত ইউনিয়নে হয় ৪৪০ শতাংশ।’’
·       গৃহযুদ্ধের পর এক দশকের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীভূত
·       সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে সাত বছরের সার্বজনীন শিক্ষা এবং দশ বছরের সার্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা যা সেই সময়ে ইউরোপের অন্য কোনো দেশ অর্জন করতে পারেনি।
·       জমিদারি প্রথার বিলোপ এবং গরিব কৃষক ও খেতমজুরদের যৌথ খামার এবং সমবায়ে অংশীদারিত্ব
·       বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই সমস্ত নাগরিকদের নিখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা।
·       বেকারত্ব দূর করে সকলের জন্য কাজের ব্যবস্থা। প্রত্যেকের জন্য কাজের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় ১৯৩৬ সালের মধ্যে সমস্ত এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
·       নতুন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মহিলাদের সমানাধিকার, সবার সমান মজুরি, মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধার অধিকার এবং বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সুনিশ্চিত করা। এছাড়াও মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার। এই অধিকার ১৯২৮ সালে একমাত্র ব্রিটেন দিয়েছিল তাদের দেশের মহিলাদের।
·       সাংস্কৃতিক সম্পদের বিরাট সম্প্রসারণ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় খরচে বিভিন্ন বইপত্র, তার সঙ্গে চলচিত্র, সঙ্গীত ও শিল্পকলা নিয়ে প্রকাশ ও পরিবেশনা।



নভেম্বর বিপ্লবের ঐতিহাসিক প্রভাব
১৯১৭ সালের আগে পৃথিবী যা ছিল, বিংশ শতাব্দীর শেষে এবং আজকের তুলনায় তা সম্পূর্ণ আলাদা। বিংশ শতাব্দীর শুরুটা তখন ছিল সাম্রাজ্যের যুগ- সাম্রাজ্যবাদ ছিল উচ্চ শিখরে। পৃথিবীকে ভাগ করে কর্তৃত্ব নিয়েছিল বৃটিশ, জার্মান, ফরাসি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান, রাশিয়ান ও জাপানি সাম্রাজ্য। এর নিচে সাম্রাজ্য ছিল ইতালিয়ান, পর্তুগীজ ইত্যাদিরপৃথিবীর জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ এসব সাম্রাজ্যের অধীনে উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশের বাসিন্দা ছিল। এই পুরনো ধরণের উপনিবেশবাদের অবসান ঘটে রুশ বিপ্লবের সূচনায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদের মৃত্যু যাত্রা শুরু হয়। জার সাম্রাজ্যের উৎখাতের ৫০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বুকে আর কোনো সাম্রাজ্য ছিল না বললেই চলে। নভেম্বর বিপ্লব জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলিকে উদ্দীপ্ত করে। এই মুক্তি সংগ্রামগুলি ঔপনিবেধিক শাসনগুলিকে উৎখাত করে। প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্যের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম উচ্চতর মাত্রায় পৌঁছায়। রুশ বিপ্লব থেকে অনুপ্রেরণা পায় এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে।
নভেম্বর বিপ্লবের ভিত্তি ছিলো শ্রমিক কৃষক মৈত্রীর বিপ্লবী রণনীতি। এই শ্রমিক কৃষক মৈত্রীর রণনীতিই পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক ও আধাঔপনিবেশিক দেশগুলিতে ব্যপক কৃষক সমাজকে সমবেত করতে ব্যবহার করা হয়। নভেম্বর বিপ্লবের প্রদর্শিত পথে তিন দশক পরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যুগান্তকারী চীন বিপ্লব সংগঠিত হয়। এরপরে হয় ভিয়েতনাম ও কোরিয়ার বিপ্লব। এই সমস্ত বিপ্লব বিশ্বব্যপী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও ১৯৩০- দশকের ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামের প্রত্যক্ষ ধারাবাহিকতায় সংগঠিত হয়েছে। এর পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক শিবির।
মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিচালিত সংগ্রামের জন্যই বিংশ শতাব্দীর সেরা বিপদ ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হয়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের দেশপ্রেমিক যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২কোটিরও বেশি সেনা ও মানুষ প্রাণ হারায়। নাৎসী যুদ্ধ সম্পর্কে ধংস করার নেতৃত্ব দেয় লাল ফৌজ।
নভেম্বর বিপ্লবের মুক্তিকামী অবদানে রয়েছে বিশ্বব্যপী প্রভাব। রুশ বিপ্লবের সাফল্য বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলির প্রভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদী সরকারগুলি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় মডেল চালু করতে বাধ্য হয়। এই সব দেশের শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের জন্য সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।



ভারতে প্রভাব
নভেম্বর বিপ্লবের সংবাদ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে এবং বাইরের বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।
১) কংগ্রেসের মধ্যে মডারেট অংশ সম্পর্কে অসন্তুষ্ট র‌্যাডিক্যাল অংশ যেমন বাল গঙ্গাধর তিলক এবং অন্যান্যরা রাশিয়ার বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান এবং তাঁরা শ্রমিকশ্রেণীকে সংগঠিত করার পক্ষে ছিলেন।
২) রুশ বিপ্লবের প্রভাবে ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৯০৮ সালের আগে শিল্প শ্রমিকদের সংগঠিত করার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা ছিলো না। ধর্মঘটও হতো কচিৎ। ১৯১৮ সালে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের সূচনা হয় এবং অনেকগুলি শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠন গড়ে ওঠে ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে দেশে বেশকিছু ধর্মঘটের জোয়ার বয়ে যায়।
৩) মোহাজীর গোষ্ঠীগুলির রুশ বিপ্লবের সঙ্গে পরিচিত হতে আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। খিলাফৎ আন্দোলনের পরিণামে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ছিলেন ক্ষুব্ধ। এদের মধ্যে কয়েকজন ভারতের প্রথম কমিউনিস্ট
৪) নভেম্বর বিপ্লবের পর সমাজতন্ত্রের সাফল্যে মুগ্ধ হন বিশিষ্ট লেখক কবি যেমন সুব্রহ্মনিয়াম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজি নজরুল ইসলাম প্রমুখ। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া সফর করে যে নতুন সমাজ গড়া হচ্ছে তাতে মুগ্ধ হয়ে ‘রাশিয়ার চিঠি’তে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি নিজের চোখে না দেখলে কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারতুম না যে, অশিক্ষা ও অবমাননার নিম্নতম তল থেকে আজ কেবলমাত্র দশ বৎসরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায় নি, মনুষ্যত্বে সম্মানিত করেছে। শুধু নিজের জাতকে নয়, অন্য জাতের জন্যেও এদের সমান চেষ্টা। অথচ সাম্প্রদায়িক ধর্মের মানুষেরা এদের অধার্মিক বলে নিন্দা করে। ধর্ম কি কেবল পুঁথির মন্ত্রে, দেবতা কি কেবল মন্দিরের প্রাঙ্গণে। মানুষকে যারা কেবলই ফাঁকি দেয় দেবতা কি তাদের কোনোখানে আছে। অনেক কথা বলবার আছে। এরকম তথ্য সংগ্রহ করে লেখা আমার অভ্যস্ত নয়, কিন্তু না-লেখা আমার অন্যায় হবে বলে লিখতে বসেছি। রাশিয়ার শিক্ষাবিধি সম্বন্ধে ক্রমে ক্রমে লিখব বলে আমার সংকল্প আছে। কতবার মনে হয়েছে আর-কোথাও নয়, রাশিয়ায় এসে একবার তোমাদের সব দেখে যাওয়া উচিত।’’ 
জওহরলাল নেহরু থেকে পেরিয়ার রামস্বামী পর্যন্ত যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সফর করেছিলেন তাঁরা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাফল্যে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভগৎ সিং এবং তাঁর কমরেডরা রুশ বিপ্লব ও লেনিনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩০ সালের ২১শে জানুয়ারি আদালত কক্ষ থেকে তাঁরা মস্কোর উদ্দেশ্যে এই টেলিগ্রাম করেছিলেন, -‘লেনিন দিবসে মহান লেনিনের আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যারা কিছু কাজ করছেন তাঁদের সকলের উদ্দেশ্যে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। রাশিয়া যে মহান পরীক্ষানিরিক্ষা করছে আমরা তার সাফল্য কামনা করি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের কন্ঠেই আমরা কন্ঠ মেলাচ্ছি।’
একারণে, ভারতের স্বাধীনতা ও সামাজিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম রুশ বিপ্লবের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়।

কীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি ঘটলো? 
পুঁজিবাদী বেষ্টনী রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মধ্যে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সবসময় সাম্রাজ্যবাদী হুমকির মুখে থাকতে হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিলো ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনেরও লক্ষ্যবস্তু। এসমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুন পথে উদ্ভাসিত হয় এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঠিক আমেরিকার পরেই শক্তিধর দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অন্তর্নিহিত বিরাট সাফল্যের সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যায় সোভিয়ত ইউনিয়নে দ্রুত আর্থিক বিকাশ, বেকারীত্বের অবসান, সার্বজনীন শিক্ষা স্বাস্থ্যরক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং জনগণের বস্তুগত সাংস্কৃতিক মানের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে
অবশ্য ক্রমশ বিশেষত শেষ দুই দশকে কিছু ত্রুটি ও ঘাটতি দেখা দেয়। নতুন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সাফল্যকে কাজে লাগাতে অর্থনৈতিক কাঠামোর সংস্কার করা হয়নি; অর্থনীতির পরিচালনায় পুণর্গঠনের ব্যর্থতা দেখা যায়; জনগণের বৈষয়িক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের সম্প্রসারণের ঘাটতি আমলাতান্ত্রিকতার দিকে নিয়ে যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে জনগণের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধারণার বিকাশ ঘটাতে কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শগত ব্যর্থতা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ডেকে আনে।
সমাজতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্র নির্মাণে বিকৃতি এবং মতাদর্শগত বিচ্যুতি সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যর্থতা ঘটায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র নির্মাণে অভিজ্ঞতার ঐতিহাসিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে এটা বলা যেতে পারে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তিতে বর্তমান বিশ্বে সমাজতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা শেষ হয়ে যায় না।



নভেম্বর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা
নভেম্বর বিপ্লব মানব সমাজের কাছে দেখিয়েছে যে পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
নভেম্বর বিপ্লবের দৃষ্টান্ত বিংশ শতাব্দীতে শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে। একবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদের বিকল্প পথকে আলোকিত করে চলেছে নভেম্বর বিপ্লব।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের পর বিশ্ব পুঁজিবাদের ও সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য এসেছে। একবিংশ শতাব্দীতে নয়া উদারনীতির পুঁজিবাদ গোটা পৃথিবীকে মুষ্ঠিমেয় ধনী এবং দারিদ্র, বেকারী ও ক্ষুধায় আক্রান্ত বিশাল জনগণের মধ্যে বিভাজনকে প্রশস্ত করেছে।
দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছে অসাম্যের। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ১শতাংশের সম্পদের পরিমান ১, ১০,০০,০০০ কোটি টাকা যা পৃথিবীর জনসংখ্যার নিচের তলার অর্ধেকের মোট সম্পদের ৬৫গুন বেশি। পৃথিবীর ১৩০কোটি মানুষ চরম দারিদ্রের মধ্যে বাস করছেন।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ বিশ্ব আধিপত্যের জন্য আগ্রাসী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে এবং সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ধংসাত্মক সংঘর্ষ চাপিয়ে দিয়েছে যা এখনো চলছে ইরাক সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন এবং আফগানিস্তানের মতো দেশগুলিতে।
নয়া উদারনীতির আক্রমণ, ব্যয়সংকোচের নামে জনগণের ওপরে আঘাত এবং সাম্রাজ্যবাদের কাছে পদানত করার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যপী শ্রমিকশ্রেণী ও শ্রমজীবী জনগণের অন্যান্য অংশ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আলোকবর্তিকা।
সমস্ত বিপ্লবী ও প্রগতিশীল শক্তির কাছে নভেম্বর বিপ্লব অনুপ্রেরণার উৎস। শ্রেণীহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যারা সংগ্রাম করছেন তাঁদের কাছে নভেম্বর বিপ্লব এই বার্তা দিয়ে যাচ্ছে যে সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ।

************


2 comments:

  1. নভেম্বর বিপ্লব যে শিক্ষা দিয়ে গেছে সেই শিক্ষা মেহনতীমানুষ কোনদিন কোনদিন ভুলতে পারবেনা এবং সেই শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষ একদিন এই পৃথিবীতে পাল্টাবে

    ReplyDelete
  2. অবশ‍্যই মেহনতি মানুষ পৃথিবীকে একদিন পাল্টাবে। নভেম্বর বিল্পব দীর্ঘজীবী হোক।

    ReplyDelete