20161101

নেলসন মান্ডেলাঃ ১৯১৮-২০১৩

৫ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে বিদায় নিলেন নেলসন মান্ডেলা, দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদী নেতা, কালো মানুষের বিশ্বস্ত মুক্তিযোদ্ধা, দেশের বড়ো আদরের মাদিবা। শেষ কয়েক মাস অশক্ত অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন; বিশ্বের অনেক মানুষ আশঙ্কায় দিন কাটিয়েছেন। পঁচানব্বই বছর পার করে অমরত্বের পথে পাড়ি দিলেন প্রবাদপুরুষ।

বিংশ শতাব্দীর বড়ো জননেতাদের মধ্যে নেলসন মান্ডেলার নাম থাকবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তালিকায় বেশ কয়েকজনের নাম লেখা হবে। কিন্তু পুরো একটা জাতির জনক বা বিশ্বের বিপুল মানুষের আকাঙ্ক্ষার অধিনায়ক হয়ে ওঠা সহসা ঘটে না। লেনিন বা গান্ধী যেমন, যেমন মাও জে দং বা হো চি মিনতেমনই জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন নেলসন মান্ডেলা। অনেকের মতে স্বদেশের চেয়ে বিদেশেই বেশি পূজ্য ছিলেন তিনি; জীবদ্দশায় প্রতীক হয়ে গেলে যেমনটি হয়, মিডিয়া তাঁর এই নিরাপদ প্রতিমাটিকে লুফে নিয়েছিল। সবাই তাঁর নাম জীবদ্দশায় প্রতীক হয়ে গেলে যেমনটি হয়, মিডিয়া তাঁর এই নিরাপদ প্রতিমাটিকে লুফে নিয়েছিল। সবাই তাঁর নাম শুনেছে, সবাই তাঁকে সম্মান জানায়, রাষ্ট্রনেতারা তাঁর করমর্দন করে ধন্য হন, চিত্রতারকারা হুড়োহুড়ি করে তাঁর সঙ্গে ছবি তোলে। প্রতিমার আড়ালে অবশ্য অন্যতর বাস্তব লক্ষ করা যায়। অন্য যুগপুরুষদের মতো চিন্তাবিদ তিনি ছিলেন না, নতুন কোনো দর্শন তিনি পত্তন করেননি, সংগ্রামে বা সমাজচিন্তায় নির্দিষ্ট কোনো যুগান্তর আনেননি। স্বাধীনতার লড়াইতেও তাঁর নেতৃত্ব ছিল দৃঢ় কিন্তু প্রথাগত, সহকর্মীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই তিনি চলতেন ও আন্দোলন চালাতেন। ঝোঁক ছিল অহিংস আন্দোলনে, কিন্তু যখন এ.এন.সি সশস্ত্র সংগ্রামের পথে গেল, তখন তিনি আর গান্ধীবাদী পথ আঁকড়ে থাকলেন না, ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুখোমুখি আক্রমণে। সবার সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলতেই তিনি পছন্দ করতেন। সে কারণেই নতুন বিধানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে তিনি যে খুব বড়ো কোনো সংস্কার সাধন করতে পেরেছেন তাও বলা যাবে না, কারণ তখন তাঁর কাছে পুরোনো রাজের সঙ্গে রফার একটা দায় এসে পড়েছে। কিন্তু সময়ের সবেচয়ে প্রগতিশীল, সর্বথা গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক বোঝাপড়ার রাজনৈতিক রূপকার হিসেবে মান্ডেলা অবিস্মরণীয়। তেমনি অবিস্মরণীয় তাঁর সর্বপ্রধান কীর্তি: বর্ণবিদ্বেষে বিভাজিত, হিংস্রতায় বিক্ষত, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ নানা জনগোষ্ঠীর মানুষকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চৌহদ্দিতে সামিল করা।

এই ঐতিহাসিক সাফল্যের জন্য তাঁকে অনেক ব্যক্তিগত দাম চোকাতে হয়েছে। জেলখানায় সাতাশ বছর কেমন যেন ধারণার মধ্যে আসে না। এই অতিপ্রাকৃতিক অত্যাচার তিনি সয়েছিলেন দেশের মানুষের কথা ভেবে। আসলে দীর্ঘ কারাবাসের বিকল্প হিসেবে একেবারে খতম করে দেবার মতলব এটেঁছিল অ্যাপারটাইডস সরকার। ১৯৬৩ সালে দেশদ্রোহিতার মামলায় সেটাই ছিল কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য, নেহাত শ্বেতাঙ্গ জজসাহেবের শেষ মুহূর্তের শিথিলতায় যাবজ্জীবনের আদেশ হয়। জীবনের সবচেয়ে দামি সবচেয়ে সৃজনশীল দিনগুলো গারদের আড়ালে কেটে গেল, সহ্য করতে হল ইতরতম অত্যাচার, প্রিয়জনের থেকে দূরে থাকতে হল, রুদ্ধ হয়ে গেল আন্দোলনে যোগ দেবার রাস্তামান্ডেলার নৈতিক মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দেবার আয়োজন ছিল ব্যাপক। সবাই জানে সেই বর্ণবিদ্বেষী প্রকল্পের ভগ্নদশার ইতিহাস। রবেন দ্বীপে কারাবাস, তারপর অন্য জেলে, হাড়ভাঙা খাটুনি, অপকৃষ্ট খাবার, ন্যূনতম সুযোগসুবিধার অভাব, যক্ষ্মার সংক্রমণ, কোনো কিছুতেই দমানো গেল না এই একগুঁয়ে জেদি লক্ষ্যে অবিচল অনুদ্‌বিগ্নমনা মুক্তিযোদ্ধাকে।

আদালতে মান্ডেলার ঐতিহাসিক জবানবন্দি এখনও বিশ্বের বিবেক শিহরণ জাগায়।

আমার জীবন আমি আফ্রিকার জনগণের এই লড়াইতে উৎসর্গ করেছি। আমি লড়েছি সাদা আধিপত্যের বিরুদ্ধে, যেমন লড়েছি কালো আধিপত্যের বিরুদ্ধে। আমি আদর্শ হিসেবে নিয়েছি স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক এক সমাজব্যবস্থাকে যেখানে সব মানুষের সমান অধিকার থাকবে আর থাকবে সামাজিক ঐক্য। আমি এই আদর্শের জন্যই বাঁচতে চাই; আশাকরি একদিন এটি রূপায়িত হবে। যদি দরকার হয় আমি এই আদর্শের জন্য মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত।

১৯৬৩ সালের এই ঘোষণাকে দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিসংগ্রামের আশু লক্ষ্য হিসাবে নিলে ভেবে দেখা দরকার ঠিক কী ধরনের গণতন্ত্র এবং সামাজিক ঐক্য চেয়েছিলেন যুবক মান্ডেলা, আর দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা-সংগ্রাম কোন অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছতে চেয়েছিল। এই সংগ্রামের অনেক শরিক ছিল, ভিতরে ছিল অনেক টানাপোড়েন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস আর দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ছিল কয়েকটি স্থানীয় দল; আর প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি ছিল জুলু ইনকাথা পার্টি। এরা সবাই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের অবসান চেয়েছিল, কিন্তু তার পর কি হবে তাই নিযে কখনো একমত হতে পারেনি। কমিউনিস্ট পার্টির সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অবশ্য ছিল তুলনায় স্পষ্ট, সারা পৃথিবীর সাম্যবাদীরা যেমন চেয়ে এসেছে তারাও তেমনিভাবে চেয়েছিল শ্রেণিহীন সমাজ, কেবল বর্ণবিদ্বেষের অবসান নয়। নুতন রাষ্ট্র ব্যক্তিগত পুঁজি রাষ্টায়ত্ত্ব করে নেবে, সমানভাবে বণ্টিত হবে দেশের ঐশ্বর্য এবং আয়, সবার সমান অধিকার থাকবে খাদ্য স্বাস্থ্য শিক্ষা ইত্যাদির সংস্থানে। অবশ্য নেতা জো স্লোভো চাইতেন বিলম্বিত সূর্যাস্তের মতো ধীরগতির পরিবর্তন। মান্ডেলা একসময় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, কেন্দ্রীয় কমিটিতেও নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্ট মতাদর্শে তাঁর সম্পূর্ণ আস্থা ছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তাঁর আত্মজীবনী পড়লে মনে হয় যে নিজের জোজা (Xhoza) আদিবাসী সমাজের চিরায়ত সামাজিক ঐক্য তাঁর মনে যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল তার তুলনায় অন্যান্য ধারণা তেমন জোরালো হয়ে ওঠেনি। শ্রেণি-সংগ্রাম হয়তো তাঁর কাছে তেমন বাঞ্ছিত ছিল না, কারণ কৌম সমাজের সাধাসিধে ভ্রাতৃত্ব অসাম্যকে মেনে নিয়েই তৈরি হয়ে ওঠে; তার গড়নে সম্পদ ও ক্ষমতার উচ্চাবচতা থাকে, নারী-পুরুষের সমানাধিকার থাকে না, কিন্তু সবাই অংশীদার হওয়াতে একটা সাম্যের আবহ বিরাজ উচ্চাবচতা থাকে, নারী-পুরুষের সমানাধিকার থাকে না, কিন্তু সবাই অংশীদার হওয়াতে একটা সাম্যের আবহ বিরাজ করে সমাজের যৌথ কাজকর্মে। এটা একোবরেই আশ্চর্য নয় যে বর্ণবিদ্বেষী জমানার অবসানের দাবির সঙ্গে অর্থনৈতিক অসাম্য দূরীকরণের প্রকল্প পুরোপুরি জাড়িয়ে নেননি মান্ডেলা। তাঁর কাছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেজন্য সাদা-চামড়া গোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের জমানার অবসান আশঙ্কা করে মান্ডেলাকে বারবার টোপ দিয়েছিল জেল থেকে বেরিয়ে তাদের শর্তে বোঝাপড়ার সন্ধান করার জন্য। বলা বাহুল্য, মান্ডেলা পূর্ণ স্বাধীকারের কোনো বিকল্প গ্রহণ করতে রাজি হননি।

শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালে বিনা শর্তে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবার পর মান্ডেলাকেই অন্তিম ভরসা হিসাবে আঁকড়ে ধরেছিল বর্ণবিদ্বেষী নেতৃত্ব, নতুবা জনরোষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত সাদা চামড়ার সম্প্রদায়, রক্তের স্রোত বয়ে যেত জনপদের রাস্তায় রাস্তায়। মান্ডেলা যখন ১৯৯৪ সালে নতুন দক্ষিন আফ্রিকা রাষ্ট্রের হাল ধরলেন তখন সাদা-কালো স্ত্রী-পুরুষ গরিব-বড়োলোক বামপন্থী-উদারপন্থী বিপ্লবী-রক্ষণশীল নির্বিশেষে তাঁকে সর্বসম্মত নেতা বলে স্বাগত জানালেন জনসধারণ। তাঁরা জানতেন যে এই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন মাদিবা।

এক দফা রাষ্ট্রপ্রধান থেকেই মান্ডেলা সরকারি কাজ থেকে অব্যাহতি নিলেন ১৯৯৯ সালে; ২০০৪ সালে, তাঁর কথায়, ‘অবসরথেকেও অবসরতাঁর প্রাপ্য বলে জানালেন। ততদিনে বয়স হয়েছে ছিয়াশি, শরীর ভেঙে পড়েছে অন্ধকারায় দীর্ঘ দিনযাপনের ফলে, ফুসফুসে বাসা বেঁধেছে মারনরোগের নিয়ত সম্ভাবনা। ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনেও নানা ঘাত-প্রতিঘাত সামলাতে হয়েছে তাঁকে। দ্বিতীয় স্ত্রী উইনি-র সঙ্গে সরকারি ভাবে ১৯৯২ সালে বিচ্ছেদ হয়, যদিও জেলে থাকতেই উইনি-র উচ্ছৃঙ্খল এবং অসামাজিক কাজকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের অনেকেও তাঁকে নানাভাবে দুঃখ-ক্লেশ দিয়েছে। বড়ো পরিবারের কর্তা আর আদিবাসী সমাজের রাজপুরুষ হিসেবে তাঁকে নানারকম দায় নিতে হয়েছে, যার ঝুটাঝামেলা নেহাত কম ছিল না। একেক সময়ে এমন গুঞ্জন শোনা গেছে যে মাদিবা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নানাভাবে নিজের ও পরিবারের আখের গুছিয়ে নিতে পরাঙ্মুখ ছিলেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান হিসেবে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান এবং আত্মত্যাগের নিরিখে অনেকেই এইসব মানুষী দুর্বলতাকে তেমন গুরুত্ব দিতে রাজি নন। শেষ বয়সে মোজাম্বিকের প্রয়াত জননায়ক সামোরা মাকেল-এর বিধবা স্ত্রী গ্রাকা-র সঙ্গে বিয়ে হবার পর অপেক্ষাকৃত শান্তিতে তাঁর দিন কেটেছিল। এই অন্তিম সুখটুকু তাঁর প্রাপ্য ছিল।

যে দক্ষিণ আফ্রিকাকে মান্ডেলা রেখে গেলেন সেটি তেমন সুখী দেশ নয়। সম্পদের বৃহদংশ এখনও সাদা চামড়ার লোকেদের হাতে, তাদের অতীত কুকর্মের জন্য তেমন ফলভোগও করতে হয়নি। মান্ডেলা সরকারের ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন অনেক কিছু ধামাচাপা দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বহুজাতিকদের দাপট অব্যাহত। চারিদিকে অন্যায় বঞ্চনা হিংসার আতিশয্য, চুরি-ডাকাতির সমূহ উপদ্রব। দেশের মানুষ নিরাপদ নয়, আগেকার গরিবেরা গরিবই রয়ে গেছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও একটা আসল কথা হচ্ছে এই দেশ এখন স্বাধীন, বর্ণবৈষম্য অতীত, সব মানুষের সামনে অন্তত রয়েছে সম্ভাব্য বিকাশের খোলা রাস্তা। সেজন্য সাম্প্রতিক কালের প্রধান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনানীর তিরোধানে তাঁকে অন্তিম সেলাম জানানো বিশ্ববাসীর কর্তব্য।

সম্পাদকীয়, ‘আরেক রকম’

প্রথম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ১৬-৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ৩০ অগ্রহায়ণ-১৫ পৌষ ১৪২০
Copyright @ Arekrakam

No comments:

Post a Comment