ড. অসীম দাশগুপ্ত
কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করছেন
অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। নোট বাতিলের পর এই কেন্দ্রীয় বাজেটের দিকে তাকিয়েছিলেন
অনেকেই। কিন্তু কী পাওয়া গেল এই বাজেট থেকে? আশার বাণী ছাড়া
আর কিছু কি মিলবে? নাকি বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর বোঝা?
সেই বিশ্লেষণই রয়েছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের কলামে।
গণশক্তি, ২রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
কেন্দ্রীয় বাজেট শুধুমাত্র
সর্বভারতীয় স্তরে ভারত সরকারের আয় ও ব্যয়ের যান্ত্রিক হিসেব নয়। এই হিসেবের পিছনে
যে লক্ষ্যগুলি আছে তা সাধারণ মানুষ জানতে চান, এবং জানতে চান স্বচ্ছতার সঙ্গে। বুঝে
নিতে চান এই বাজেটের মাধ্যমে তাঁদের সমস্যাগুলির কতটুকু প্রশমন সম্ভব হবে।
এই সমস্যাগুলির মধ্যে
সর্বাপেক্ষা জ্বলন্ত হলো বেকারত্বের সমস্যা। বি জে পি’র নেতৃত্বে
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার গত প্রায় তিন বছর ধরে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, প্রতি বছর সমগ্র দেশে নতুন করে অতিরিক্ত ২ কোটি বেকার যুবক-যুবতীর কাজ
দেওয়া হবে। কিন্তু এই সময়কালেই কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম মন্ত্রকের প্রকাশিত তথ্য
অনুযায়ী গত তিন বছরে প্রতি বছরে বাস্তবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অনেক কম—৫ লক্ষেরও কম, এবং বর্তমান বছরে, বিশেষ করে এই কেন্দ্রীয় সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পর কৃষি, অসংগঠিত শিল্প এবং ছোট ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই কর্মসংস্থানের
পরিমাণ আরো হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.৫ লক্ষের মতো। তাই এই কেন্দ্রীয়
বাজেটে উচিত ছিল প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে ২০১৬-১৭ সালে কর্মসংস্থান সৃষ্টির
উপযুক্ত লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা এবং সেই লক্ষ্যমাত্রাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে —
কৃষি, শিল্প ও পরিষেবার ক্ষেত্রে — সেই লক্ষ্যমাত্রা ভেঙে ভেঙে দেখানো, এবং বাজেটে
বিভিন্ন ক্ষেত্রে কি কি পদক্ষেপের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব, তাও স্বচ্ছতার সঙ্গে বলা। কিন্তু এই বাজেটের কোথাও এই লক্ষ্যমাত্রা বা
পরবর্তী পদক্ষেপগুলির উল্লেখ নেই। অর্থাৎ নোট বাতিলের মাধ্যমে বেকারত্বের এই
সমস্যাটির আরও ব্যাপকভাবে সৃষ্টি করার পর তা প্রশমনের সম্বন্ধে উপলব্ধি করতেই
ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান সরকারের এই বাজেট।
এই বছরে আরেকটি বাড়তি সমস্যা
সৃষ্টি হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কারণে। যেহেতু এই
সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় (৮ই নভেম্বর, ২০১৬) বলা হয়েছিল এই পদক্ষেপের পিছনে
প্রধান কারণ কালো টাকা উদ্ধার করা, তাই এই সিদ্ধান্তের ফলে
শুধু বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে তাই
নয়, প্রতিদিন ব্যাঙ্ক এবং এ টি এমের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে
অসুস্থ হয়েছেন ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এবং মারাও গেছেন ১০০জনের বেশি ব্যক্তি। তাই এই
বাজেটে উচিত ছিল যে, যার জন্য মানুষের এত ক্ষতি স্বীকার সেই
কালো টাকার কত পরিমাণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে জানানো এবং কত দিনের
মধ্যে নগদ টাকার চাহিদার এবং জোগানের মধ্যে ভারসাম্য স্বাভাবিক হবে, তারও নির্দিষ্ট উত্তর দেওয়া। কিন্তু এই দুটি প্রশ্নেরই কোনো উত্তর পাওয়া
গেল না এবারের বাজেটে।
বর্তমান এই বাজেট পেশ করার আগে কেন্দ্রীয়
সরকারের তরফ থেকেই প্রত্যাশা সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, সমস্ত দরিদ্র মানুষের জন্য একটি
ন্যূনতম আয়ের সংস্থানের প্রকল্পের কথা চিন্তা করা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত
এবছরের আর্থিক সমীক্ষা (২০১৭, পৃঃ ১৭৩-১৯৫)তে নির্দিষ্টভাবে
উল্লেখ করা হয়েছে যে, অন্তত পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রকল্প চালু
করা হোক, অথবা অন্তত আলোচনার জন্য পেশ করা হোক। যেহেতু
অর্থমন্ত্রকই এই সমীক্ষার দায়িত্বে থাকে, তাই অর্থমন্ত্রীর
বাজেট বিবৃতিতে কোথাও এই প্রকল্পের উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেখা গেল এর
কোনো উল্লেখই নেই। অর্থাৎ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের একটি মন্ত্রকের ভিতরেই রয়েছে
সমন্বয়হীনতা।
প্রতি বছরে কেন্দ্রীয় বাজেটে মোট
ব্যয়কে পরিকল্পনা খাতে ব্যয় (অর্থাৎ নতুন প্রকল্পগুলির জন্য ব্যয়) এবং পরিকল্পনা
বহির্ভূত খাতে (অর্থাৎ চালু প্রকল্প, রক্ষণাবেক্ষণ এবং বেতন ইত্যাদি খাতে
ব্যয়) আলাদা করে দেখানো হতো—এবং এটাই উচিত। এবারই প্রথম দেখা
গেলো পরিকল্পনা এবং পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ব্যয়কে মিশিয়ে দেখানো হয়েছে। এরফলে
শুধু নতুন প্রকল্পগুলির ব্যয়ের আলোচনার গুরুত্ব কম হয়েছে তাই নয়, বাড়তি অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে যে আগেকার বছরগুলির সঙ্গে আগামী বছরের
পরিকল্পনা খাতে বাজেট বরাদ্দ সঠিকভাবে তুলনাই করা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এবারের বাজেটে দেখা গেল, প্রত্যেকটি মন্ত্রকের
ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ সম্পূর্ণভাবে উল্লেখ না করে কতকগুলি মন্ত্রকের বিশেষ বিশেষ
ক্ষেত্রেই বাজেট বরাদ্দ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও বলা প্রয়োজন যে, কর্মসংস্থানের বিষয়ে প্রকল্প হিসেবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যে ১০০
দিনের কাজের প্রকল্প, সেখানে বর্তমান বছরে যে বরাদ্দ ছিল ৪৭,৪৯৯ কোটি টাকা তার থেকে আগামী বছরে অত্যন্ত সামান্য বৃদ্ধি করে বরাদ্দ
হয়েছে মাত্র ৪৮,০০০ কোটি টাকা। অন্যান্য কর্মসংস্থান
প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একইভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি হয়েছে অনুরূপভাবে সামান্য। অর্থাৎ বি
জে পি-র আমলে যেখানে বেকারত্বের বৃদ্ধি হয়ে তীব্রভাবে, এবং
বিশেষ করে বর্তমান বছরে, সেখানে এই বাজেটে কর্মসংস্থান
সৃষ্টি বিষয়টিকে গুরুত্বই দেওয়া হলো না।
এই প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ করা
দরকার যে এই প্রথম রেল বাজেটকে সাধারণ কেন্দ্রীয় বাজেটের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া
হয়েছে। এরফলে ভারতীয় রেলের প্রত্যেকটি রাজ্যের যে সুবিধা অসুবিধা তা উল্লেখ করার
কোনো জায়গাই থাকলো না এই বাজেটে।
এছাড়া, এই বাজেটে
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে স্বল্প আয়ের করদাতাদের ছাড়ের হিসেব যেখানে মোট ২০,০০০ কোটি টাকা, সেখানে তাদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা
হিসেবে চাপবে প্রায় ৭৫,০০০ কোটি টাকার পরোক্ষ কর। অর্থাৎ,
এই বাজেটের আয় ও ব্যয়ের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা একত্রিত করলে
আপেক্ষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ মানুষ।
সর্বোপরি, এবারের বাজেটে
কোনো উল্লেখ নেই যে, প্রতি বছর মোট কর ছাড়ের মাধ্যমে যে ৫
লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম থাকছে। তার একটি অংশও আদায় করা
গেলে সাধারণ মানুষের স্বার্থে কর্মসংস্থানের প্রকল্পগুলির জন্য আরও পদক্ষেপ গ্রহণ
করা যেত, এবং সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের প্রকল্পটিও, কিছুটা
হলেও, শুরু করা যেত।
No comments:
Post a Comment