20170328

রক্তাক্ত ভাঙড়ে বেআব্রু মমতার জমি মডেল

 সুদীপ্ত বসু
১৭ই জানুয়ারি


একজনের বয়স ২২, কলেজ ছাত্র। অপরজন গ্রামেরই বাসিন্দা, বয়স ২৪।
রক্তাক্ত ভাঙড় মঙ্গলবার দেখলো গ্রামবাসী, কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ভাঙতে পুলিশের গুলিতে দুই যুবকের রক্তাক্ত বুলেটবিদ্ধ দেহ। নবান্ন নির্বিকার, দায় এড়ানোর চেনা কৌশলে বহিরাগতর তত্ত্ব প্রশাসনের। যদিও মৃত দুই যুবক স্থানীয় গ্রামেরই বাসিন্দা।
একদিকে সাধারণ গরিব গ্রামবাসী, অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জির পুলিশ ও তৃণমূলের একাংশের সশস্ত্র দুষ্কৃতীবাহিনী। জ্বলছে পুলিশের গাড়ি, রাস্তা অবরোধ, গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরুদ্ধ গোটা এলাকা। পালটা গ্রামবাসীদের দিকে উড়ে আসছে ইট, টিয়ার গ্যাসের শেল। চলেছে গুলিও।


রণক্ষেত্র ভাঙড়।
প্রকল্পের নামে জমি মাফিয়া দিয়ে শাসক তৃণমূলের জোর করে জমি দখলের প্রতিবাদে, পুলিশি অত্যাচারে বিরুদ্ধে প্রতিবাদে একজোট গ্রামবাসীকে শেষ পর্যন্ত বন্দুক দিয়েই নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালালো তৃণমূল সরকার। পরিণামে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হলো দুই স্থানীয় বাসিন্দার।
পুলিশের গুলিতেই মঙ্গলবার শেষ বিকালে মৃত্যু হলো ২২বছরের এক তরতাজা যুবকের। পোলেরহাট-২নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের স্বরূপনগর গ্রামের বাসিন্দা আলমগীর মোল্লা। পুলিশের গুলিতে রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়েছেন। রক্তে ভেসেছে শরীর। চিকিৎসার সময়ও মেলেনি। ২২ বছরের আলমগীর কলেজ ছাত্র। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও অনেকে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনজনকে নিয়ে আসা হয় এস এস কে এম হাসপাতালে। রাতেই সেখানে মৃত্যু হয় ২৪ বছর বয়সি যুবক মফিজুল শেখের। পোলেরহাট-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের গাজীপুরের শেখপাড়ার বাসিন্দা এই বছর চব্বিশের যুবক।
জোর করে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে জমি মাফিয়া মারফত তৃণমূলের জমি দখল, রাতের অন্ধকারে পুলিশের অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নজির গড়েছে ভাঙড়। প্রশাসন পিছু হটেছে, পিছু হটা প্রশাসনকে অক্সিজেনজোগাতে পুলিশের দিক থেকেই গ্রামবাসীদের তাক করে বোমা ছুঁড়েছে আরাবুল বাহিনী। তাতেও ঐক্যবদ্ধ গ্রামবাসীকে পিছু হটাতে পারেনি প্রশাসন। সকাল থেকে চলা অবরোধ, বিক্ষোভের জেরে স্তব্ধ হয়েছে ভাঙড়, রাজারহাট লাগোয়া পোলেরহাটের বিস্তীর্ণ প্রান্ত। বিকালের দিকে সেই স্তব্ধ হয়ে যাওয়া জনপদেই ঐক্যবদ্ধ গ্রামবাসী, জমিদাতা কৃষককে ছত্রভঙ্গ করতে চললো পুলিশের গুলি। মৃত্যু হলো দুজনের। আহত হলেন একাধিকজন।
রাত পর্যন্ত গুলি চালানোর ঘটনা অস্বীকারের মরিয়া চেষ্টা চালায় জেলা পুলিশ। রাতেই মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, বহিরাগতরা জড়ো হয়ে অশান্তি পাকাচ্ছে। এমনকি তাঁদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশও দেন মুখ্যমন্ত্রী। রাতেই পোলেরহাট-২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের খামারাটি, টোনা, মাছিডাঙা বিস্তীর্ণ এলাকায় সাধারণ মানুষের টহল। পুলিশ, র‌্যাফও ক্রমেই ঘিরছে ভাঙড়কে। উত্তেজনা রয়েছে রাতভর। উত্তেজনার চেহারা এমনই তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লাও ঢুকতে পারেননি নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে। গ্রামবাসীরাই গড়েছেন ব্যারিকেড।
বরাবরের জমি আন্দোলনের শক্ত ঘাঁটি ভাঙড় মঙ্গলবার সকাল থেকে কেন ফেটে পড়লো প্রবল ক্ষোভ, উত্তেজনায়? কেন মুহূর্তেই তা রণক্ষেত্রে পরিণত হলো? ভাঙর-২ ও ভাঙর-১ নম্বর ব্লক জুড়েই শাসক তৃণমূলের একচেটিয়া একাধিপত্য। তৃণমূলের একাধিপত্য মানে জমি মাফিয়া, দুষ্কৃতীরাজের রমরমা তা গত সাড়ে পাঁচ বছরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন গ্রামবাসীরা। সেই ভাঙড়ে ২০১৩ সালে পোলেরহাট-২নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের টোনা মৌজার নতুনহাটে ৪০ বিঘা জমিতে গড়ে ওঠার কথা পাওয়ার গ্রিড প্রকল্প। প্রথম থেকেই পোলেরহাটের মত তিন ফসলি, চার ফসলি জমি দিতে আপত্তি ছিল কৃষকদের। তখন ভাঙড়ে আরাবুলের একচ্ছত্র দাপট।
গ্রামবাসী, জমিদাতা কৃষকদের অন্ধকারে রেখেই পোলেরহাট-২নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের অফিসে নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। জমি নেওয়া হবে বলেই নোটিস দেওয়া হয়। কৃষকরাও জানেন না তাঁদের জমি দিতে হবে প্রকল্পে। সেই নোটিস দেখিয়ে তৃণমূলের নেতা আরাবুল ইসলামের বাহিনী বাইকে চেপে রাতের পর রাত হুমকি দিয়ে জোর করে ভয় দেখিয়ে কৃষকদের জমি দিতে বাধ্য করে। দীর্ঘদিন ধরেই জমছিল সেই ক্ষোভ। গ্রামবাসীদের উদ্যোগেই তৈরি হয় জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি। সেই ক্ষোভের তুষে আগুন ধরায় জমি মাফিয়াদের হয়েই পুলিশের অত্যাচার, মিথ্যা মামলা। গত নভেম্বর মাসেই আন্দোলনকারী তিন মহিলা সহ ছয়জনকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ক্ষোভের মাত্রা আরও বাড়ে।
শান্তিপূর্ণভাবেই গত ১১ই জানুয়ারি কাশীপুর থানার খামারাটিতে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা ধরে অবরোধে শামিল হন কয়েক হাজার গ্রামবাসী, মহিলারা। অসমাপ্ত বিদ্যুৎ প্রকল্পের জমি ফেরত চেয়ে, বহুফসলি জমিতে পাওয়ার গ্রিডের প্রকল্প বন্ধের দাবিতে। সেদিন কোন গন্ডগোল, উত্তেজনা ছড়ায়নি। লাওহাটি-শ্যামনগর দীর্ঘ ছয় কিলোমিটার রাস্তা অবরোধ করেই চলে সেই বিক্ষোভ।  প্রশাসনের আশ্বাসে ওঠে বিক্ষোভ। যদিও তারপরেও তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনী, জমি মাফিয়াদের হুমকি চলতেই থাকে। এরই মধ্যে সোমবার রাতে আরও একটি মিথ্যা মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে সামসুর হক ওরফে কালুকে। এই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভাঙড়-২ নম্বর ব্লক জুড়েই।
আর এরপরেই ঘটে সোমবার গভীর রাতেই ভয়াবহ পুলিশি অত্যাচারের ঘটনা। রাত প্রায় দুটো নাগাদ বিরাট পুলিশ বাহিনী পোলেরহাট-২নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের খামারাটি, টোনা, নতুনহাট, মাছিডাঙার মতো একের পর এক গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে চলে পুলিশি অত্যাচার। সোমবার রাতেই এই ঘটনার জেরেই মঙ্গলবার ভোর থেকে হাজার হাজার গ্রামবাসী, কৃষক, বৃদ্ধ, এমনকি শিশুরাও নামে রাস্তায়। ভোর ছটা থেকেই শুরু হয় পোলেরহাটের বিস্তীর্ণ প্রান্ত জুড়ে অবরোধ। শ্যামনগর থেকে বকডুবি পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার রাস্তার মোড়ে মোড়ে গাছের গুঁড়ি ফেলে শুরু হয় রাস্তা অবরোধ। সময় যত গড়িয়েছে বেড়েছে অবরোধকারীর সংখ্যা। দশ হাজারের বেশি মানুষ তখন রাস্তায়। চলছে অবরোধ।
সেই অবরোধ ভাঙতে আশেপাশের চারটি থানা এলাকার বিরাট পুলিশ বাহিনী ঢোকে এলাকায়।পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়। দুপুরের দিকে পুলিশই চারদিক দিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। গোটা এলাকা বন্‌ধের চেহারা নেয়। সব দোকানপাট বন্ধ, রাস্তা গাছের গুঁড়ি দিয়ে আটকানো। পুলিশ জনতার চক্রব্যূহেই আটকে পড়ে। আর সেই সময়েই ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে তৃণমূলের একাংশ। পুলিশকে রক্ষা করতে মাঠে নামে তৃণমূলী দুষ্কৃতীবাহিনী। পুলিশের সামনেই তৃণমূলী বাহিনী অবরোধকারীদের দিকে প্রথমে ঢিল পরে বোমা ছোঁড়ে। পরিস্থিতি মুহূর্তেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। অবরোধকারীরাও পালটা ইট ছুঁড়তে শুরু করেন। পুলিশ তখন নির্বিচারে মহিলা, পুরুষদের ওপর লাঠিচার্জ করতে শুরু করে। কার্যত রণক্ষেত্র তখন গোটা এলাকা। পুলিশের বাহিনীর সংখ্যাও তখন পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে গ্রামবাসীদের সংখ্যা। পুলিশের তরফে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো হয়। একের পর এক শেল ফাটানো হয়। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা পুলিশের গাড়িও ভাঙচুর শুরু করে।
এরপরেই পুলিশ কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় জনতাকে লক্ষ্য করে। পুলিশের গুলিতেই জমিদাতা পরিবারের নিরীহ যুবক আলমগীর মোল্লার ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। ২২ বছরে আলমগীর কলেজ পড়ুয়া, এই ঘটনায় গ্রামবাসীদের ক্ষোভের মাত্র দ্বিগুণ হয়। পুলিশের গুলিতে চারজন আহত হন। তার মধ্যে মফিজুল শেখ নামে ২৪ বছরের আরও এক গ্রামবাসী যুবকের রাতে এস এস কে এম হাসপাতালে মৃত্যু হয়।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে রাতেই মুখ্যমন্ত্রী টুইট করেন যে মানুষ না চাইলে ওখানে বিদ্যুতের প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ হবে না, প্রয়োজনে প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে। যদিও পুলিশি অত্যাচার, গুলি চালানোর ঘটনায় মুখ খোলেননি মুখ্যমন্ত্রী। বরং মুখ খুলে সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন তৃণমূলী মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা। তাঁর কথায়, ওখানে প্রথমে সমস্যা ছিল না, পরের দিকে জমি নিতে গিয়ে এমন কিছু ঘটনা হয় যাতে মানুষের ক্ষোভ বাড়ে।

খোদ মমতা ব্যানার্জির মন্ত্রিসভার সদস্য এই দাবি করলেও রাজ্য প্রশাসন উলটে গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধং দেহী মনোভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, যা আসলে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। 

১৮ই জানুয়ারি 

শ্যামনগর থেকে কামারবাড়ি যাওয়ার ভাঙাচোরা পিচ রাস্তায় চব্বিশ ঘণ্টা পরেও জমাট বাঁধা রক্তের দাগ স্পষ্ট। রাস্তার একেবারে মাঝবরাবরই চোখে পড়বে সেই শুকিয়ে যাওয়া তাজা রক্তের দাগ।
শুধুই কি রাস্তায়? ২২বছরের ছাত্র আলমগীর মোল্লা থেকে লরির খালাসি ২৮ বছরের মফিজুল শেখের নিথর দেহই প্রমাণ করছে পুলিশের গুলি চলেছে সামনে থেকে। একজনের লেগেছে গলায়, আরেকজনের তলপেটে। একেবারে সামনে থেকে, শরীরের পিছনের অংশে কোন আঘাত নেই। শুধু তাই নয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রাস্তার ধারে পড়ে থাক আলমগীরের গুলিবিদ্ধ দেহ পা দিয়ে নাড়িয়ে দেখেছিল পুলিশ, গুলি খাওয়ার পরে বেঁচে নেই তো!
২২বছরে মেধাবী নিরস্ত্র ছাত্রকে কয়েক হাত দূর থেকে গলায় গুলি চালাতে হলো কেন মমতা ব্যানার্জির পুলিশবাহিনীকে? প্রশ্ন ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।
আর উত্তর? তাও মিলেছে এদিন কামারবাড়ি থেকে টোনা, নতুনহাট, মাছিডাঙার মতো একের পর এক গ্রামে, বুধবার সকালে।
প্রায় বিধ্বস্ত, বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কাঠের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধে শামিল নিতান্তই সাধারণ গরিব গ্রামবাসী, কৃষকরা। সবজি চাষের আঁতুরঘর ভাঙড়ের পোলেরহাট-২নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের এই বিস্তীর্ণ এলাকা। ফুলকপি থেকে লঙ্কায় সেজে ওঠা মাঠ, সবুজ খেত ফেলে রেখে কৃষকরা রাস্তায়। মাঠের ফসল রক্ষাই যাঁদের ভুবন সেই মানুষগুলি সারা রাত গ্রাম পাহারা দিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই ফের রাস্তায় কেন? কীসের তাগিদ? নির্মম পুলিশি অত্যাচারের ক্ষত পুষে রেখেই এককাট্টা হয়ে থাকা কেন?
মমতা ব্যানার্জির শাসনে পুলিশের মিথ্যা মামলা, পুলিশ দিয়ে হামলার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সাক্ষী এই বাংলা। কিন্তু ভাঙড়ে মানুষ সোমবার সন্ধ্যা থেকে যে দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছে তা যেন নজিরবিহীন।
বুধবার সকালে তখন কাশীপুর থানা কয়েক কিলোমিটার দূরে শ্যামনগর মোড়ে গাছে গুঁড়ি ফেলে আটকে রাখা হয়েছে রাস্তা। পুলিশের প্রবেশ নিষেধ, জানান দিচ্ছেন গ্রামবাসীরাই। ভিড়ের মধ্যেই ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালাম। জিজ্ঞাসা করতে বলে উঠলেন, কেন তা জানতে হলে গ্রামের ভিতরে আসুন। যান নার্গিস পারভিনের কাছে।
নার্সিস পারভিনের বয়স সাড়ে তিন। ডান পায়ের দুটো আঙুল ভেঙে গেছে। রক্তের দাগ লাগা সেই পিচ রাস্তা পেরিয়েই কামারবাড়িতে নার্গিস পারভিনের বাড়িতে আসা, গোটা বাড়ি যেন ধ্বংসস্তূপ। সাড়ে তিন বছরের এই শিশুকন্যা মঙ্গলবার সকালে ঘরের সামনে উঠোনে খেলনা নিয়ে বসে খেলছিল। মমতা ব্যানার্জির পুলিশবাহিনী সাড়ে তিন বছরের নার্গিসকেও আন্দোলনকারীহিসাবেই যেন দেখেছে। সটান বাড়িতে ঢুকে প্রথমে তাঁর বাবা নুর হোসেন মোল্লাকে বেধড়ক মারধর করেছে। তারপর তার মা-কে। বাড়ির সব লোককেই মারা হয়।  দরজা, জানলা, টিভি, আলমারি ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর চোখ পড়ে নার্গিসের ওপর। আছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। এখনও হাঁটতে পারছে না ওই শিশু।
বুধবার সকাল মুখোমুখি নার্গিস পারভিন। অব্যক্ত যন্ত্রণা, চোখে জল। আধো  আধো ভাষায় শুধু বলে উঠতে পারলো, মেরেছে কাকুরা, আমার মা কোথায় ? মা-র কাছে যাবো খিদে পেয়েছে।
নার্গিস পারভিনের মা দিনিয়ারা বিবি মঙ্গলবার সকাল থেকে এখনও নিখোঁজ। কোনো হদিশ নেই। পুলিশ ও তৃণমূলীবাহিনী বাড়ি থেকেই টানতে টানতে তুলে নিয়ে গেছে। কোথায়? এখনও পর্যন্ত ভাঙড়বাসী জানেন না। শুধু দিনিয়ারা বিবি? এই পরিবারেরই চারজন এখনও নিখোঁজ। আবদুস সামাদ ও তাঁর দুই ভাইও নিখোঁজ। আবদুস সামাদ নার্গিসের জেঠু হন। সোমবার সকাল থেকে তাঁর খোঁজ নেই। কাঁদতেই কাঁদতেই চিৎকার করছিলেন তাঁর স্ত্রী মহিমা বিবি, ‘ মরদাটকে মারতে মারতে নিয়ে গেল, আমাদের ঘর সব ভেঙে দিয়েছে , খাওয়ারও কিছু নেই। জানেন আমার দুই মেয়ে কদিন ছিল এখানে। কাল সকালে যখন পুলিশ আর কিছু মুখে কাপড় বাঁধা লোকজন ঢুকলো সেই সময় আমার দুই মেয়ে নাতনিদের নিয়ে বাথরুমে লুকিয়ে পড়েছিল। সেখান থেকেও বার করে ওঁদের মেরেছে। বাথরুম থেকে বের করেছে মেয়েদের।
জমি দখলে মমতা ব্যানার্জির পুলিশের চেহারা কী হতে পারে তার আরও শিউরে ওঠার অভিজ্ঞতা তখনও যেন বাকি ছিল। কামারবাড়ি থেকে সোজা সেই নতুনহাটের পাওয়ার গ্রিডের প্রকল্পের দিকে যত এগনো ততই যেন সেই ববর্রতার ছবি। রাস্তার দুপাশে সিংহভাগ বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, কল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সোমবার মধ্যরাতে বিস্তীর্ণ এলাকাকে অন্ধকার করেই চলেছে সেই তাণ্ডব। খামারআইট গ্রামের এক মহিলার কথায়, ‘ঘরে তখন বাচ্চা নিয়ে শুয়েছিলাম। দরজায় লাথি মেরে ঢুকে ভাঙচুর চালালো পুলিশেরবাহিনী। আমার শরীরের একাধিক জায়গায় ইচ্ছা করেই ধাক্কা মারলো পুলিশ...’, শেষ করতে পারলেন না কেঁদে ফেললেন।
এক সংখ্যালঘু মহিলা তাঁর স্বামীর সামনে দাড়িয়েই যখন এই অভিযোগ করছেন, দুপুরে তখন কলকাতায় রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের সদর দপ্তরে মুখ্যমন্ত্রীর জরুরিবৈঠক চলছে। সি আই ডি-র একটি সূত্রেই জানা গেছে, মুখ্যমন্ত্রী দুটি নির্দিষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। এক,গ্রামের বহিরাগতদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে হবে, পুরানো মামলা থাকলে তাতে গ্রেপ্তার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুলিশ নয়, বহিরাগতই গুলি চালিয়েছ সেই অবস্থানেই থাকতে হবে।
সরকার প্রশাসনের দাবি আর ভাঙড়ের বাস্তবতার আসলে যোজন ফারাক। কারা বহিরাগত? কীভাবে এত পরিকল্পিত হামলা চললো? তাও স্পষ্ট হয়েছে সেই পাওয়ার গ্রিড প্রজেক্টের মাত্র ১৫০ মিটার দূরেই। রাস্তার ওপরেই বাড়ি লোকমান মোল্লার। প্রবীণ মানুষ। সঙ্গে স্ত্রী থাকেন। ছেলে বাইরে রয়েছে। সোমবার রাতে প্রথমে সেই বাড়িতেই চড়াও হয় পুলিশ আর সঙ্গে থাকে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে সেই প্রবীণ দম্পতিকে বের করে দেওয়া হয় বাড়ি থেকে। তাঁরাও এখনও নিখোঁজ। তারপর সেই বাড়িতেই ঘাঁটি গেড়ে চলে যাবতীয় অপারেশন। বাড়ির পিছনে আমবাগান। বুধবার দুপুরে সেখানেই দেখা গেল পড়ে রয়েছে পুলিশের একাধিক ইউনিফর্ম, টুপি। পুলিশের জাল আইডেনটিটি কার্ড, এমনকি ব্যাঙ্কের পাশবইওমিলেছে জিতেন্দ্র যাদব নামে উত্তরপ্রদেশের এক পুলিশ কর্মীর পরিচিতিপত্রও। এদিন দুপুরে তখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে কয়েক জোড়া হাওয়াই চটি, মদের বোতল আর গরম পোশাক।
আর এখানেই গ্রামবসীরা প্রশ্ন তুলছেন পুলিশের সঙ্গে তাহলে কারা ছিল? অপারেশন চালাতে আসা পুলিশকে কেন ব্যাঙ্কের পাশবই সঙ্গে আনতে হয়? কেনই বা গ্রামের একটি বাড়ি দখল করে সারা রাত সেখান থেকে অপারেশন চালাতে হলো? পুলিশের সামনে দাড়িয়ে আন্দোলনকারীদের দিকে বোমা ছুঁড়লো কারা? কেন পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পের ভিতরে গত দশ দিন ধরে ৫২জন দুষ্কৃতীকে দেখা গেল? আগে থেকেই কি তাহলে এই অপারেশনের পরিকল্পনা ছিল? মাছিডাঙার বাসিন্দা আন্দোলনকারী আনোয়ার মোল্লার কথায়, পুলিশ নিজে গাড়ি থেকে বসেই গুলি চালিয়েছে। পুলিশের গাড়িতে ঐ সব মুখোশ পরা আরাবুলের বাহিনীও ছিল। তাঁরা লোক চিনিয়ে দিচ্ছিল। পুলিশের বন্দুক থেকেই বেরিয়েছে গুলি। আমরা পুলিশমন্ত্রীরও ইস্তফা চাই।
শহর লাগোয়া এই ভাঙড় গত সাড়ে পাঁচ বছরে বারে বারে তৃণমূলের জমি নীতির মডেল সামনে এনেছে। কখনও আরাবুল, কখনও কাইজার। আর এবার সেই ভাঙড়-২নম্বর ব্লকের পোলেরহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের স্বরূপনগর থেকে কামারবাড়ি, নতুনহাট থেকে খামারআইট- আট কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা রক্তের বিনিময়ে, দুই যুবকের নিথর দেহের মূল্য দিয়েই প্রত্যক্ষ করলো তৃণমূলের সেই জমি মাফিয়াদের উগ্র লালসার চেহারা।
২০১৩ সালের প্রকল্প। জমি অধিগ্রহণহয়েছে। অথচ সিংহভাগ জমিদাতা, খেতমজুর ক্ষতিপূরণের অর্ধেকও পায়নি। আরাবুলের বাহিনীর দাপটে। রাতের অন্ধকারে স্রেফ বাইক নিয়ে জমি দিতে হবে এই হুমকি শুনিয়েই মমতা ব্যানার্জির দলীয়বাহিনী বেসরকারি সংস্থার হয়ে জমি কবজা নিয়েছে। শুধু নতুনহাটের ১৩ একর জমিই নয়, এই প্রকল্প সফল হলে পোলেরহাটের বিস্তীর্ণ কৃষিজমি ছিল তৃণমূলী জমি মাফিয়াদের পরবর্তী টার্গেট
নির্মম জমি মডেলের সেই চেহারাই বেআব্রু হয়ে ভাঙড়ে।
আর, তার বিরুদ্ধে রক্ত ঝরিয়েই এক অনির্বাণ প্রতিরোধের দিনলিপি এখন লিখছে সেই ভাঙড়ই।

No comments:

Post a Comment