20171226

৬ই ডিসেম্বর — অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে

সূর্য মিশ্র

আজ থেকে ২৫ বছর আগে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল সঙ্ঘ পরিবারের করসেবকরা।  ওই দিনটি ভারতের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক দিন। আজকের ভারতে সেই সাম্প্রদায়িক ও দক্ষিণপন্থী শক্তি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বিপদকে প্রতিহত করতে পারে গণসংগ্রাম ও গণপ্রতিরোধ। সেজন্য প্রস্তুত হতে হবে সংগঠনকে । সে কথাই লিখেছেন লেখক।

এবারের ৬ই ডিসেম্বর কালাদিবসের তাৎপর্য অন্যান্যবারের তুলনায় অ‍‌নেকখানি আলাদা। ২৫ বছর ও ভারতের সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকারের মৃত্যুবার্ষিকী ছাড়াও যেটা মনে রাখা দরকার যে নানাবিচারে এবছর, ৬ই ডিসেম্বরের প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের একটা অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। তামাম দুনিয়ার পটভূমিটাই দ্রুত বদলাচ্ছে।

হোয়াইট হাউসে এর আগে ট্রাম্পের মতো একজন রাষ্ট্রপতি এই প্রথম। ঠিক যেমন ভারতে মোদীর মতো একজন প্রধানমন্ত্রী বা উত্তর প্রদেশে যোগীর মতো মুখ্যমন্ত্রী। এরা সবাই কার্যত ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ট্রাম্পের ঘোষণা আমেরিকা কেবল শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের জন্য। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মুখে যাই বলুন না কেন ব্রেক্সিটের মূল কথা হলো ব্রিটেন কেবল ব্রিটিশদের জন্য। মোদীর ভারত মানে হিন্দুস্থান কেবল হিন্দুদের জন্য। ইউরোপের সাংসদদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখন নিজ নিজ দেশের উগ্রদক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন। ‘মান্থলি রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় (১লা জুন, ২০১৭) রচনায় জন বেলামি ফস্টার যে নামে ডাকা হোক না কেন সাধারণভাবে এদের সকলের আর্থ-সামাজিক গণভিত্তি, রাজনীতি এবং বংশপঞ্জির অনুসন্ধান করেছেন। দেখা যাচ্ছে যে উগ্র ফ্যাসিবাদী ইতালীয় দার্শনিক জুলিয়াস ই‍‌ভোলা (Julius Evola) (১৮৯৮-১৯৭৪) মুসোলিনিকে জাতি, জাতিবাদ ও তাঁর মতবাদের পক্ষে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। তিনি কেবল দর্শন নয়, রাজনীতি, অর্থনীতি-আধাসামরিক দলীয় সংগঠন এমন কি সামরিক বিষয়েও মুসোলিনির পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করতে করতে জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের সময় নাৎসিবাদকেই ইতালির তুলনায় উন্নততর ফ্যাসিবাদ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে মুসোলিনির পতনের সময় তিনি বার্লিনে হিটলারের জেনারেল হেড কোয়ার্টারেই অবস্থান কর‍‌ছিলেন। যুদ্ধোত্তর পর্বে তিনিই ইউরোপ থেকে আমেরিকার সমস্ত নয়া ফ্যাসিবাদীদের ‘আধ্যাত্মিক জনক’ (স্পিরিচুয়াল ফাদার) হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে‍‌ছিলেন। ইভোলার রচনাবলি ও জীবনীকারদের বিবরণ এই প্রবন্ধের আ‍‌লোচ্য বিষ‌য় নয়। এককথায় তিনি ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের কারণগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুলত্রুটিমুক্ত বিশুদ্ধ ফ্যাসিবাদের দিশারি বলে তাঁর অনুগামীদের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছেন। অধুনা পরিত্যক্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রধান উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন তথা আমেরিকার ফ্যাসিবাদের নবতম সংস্করণ ‘অলট-রাইট’ অর্থাৎ বিকল্প দক্ষিণপন্থীদের ইভোলার উত্তরসূরি বলা যায়। এই ধারাবিবরণীর সঙ্গে মোদী বা মোহন ভাগবতের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এঁদের পূর্বসূরি মু‍‌ঞ্জে যখন মু‍সোলিনির ইতালিতে ফ্যাসিবাদের পাঠ নিতে গি‍‌য়েছিলেন তখন তাঁদের গুরুর গুরুদেব ইভোলারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল কিনা সেটা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। ৬ই ডিসেম্বরের ২৫ বছরে যা প্রাসঙ্গিক তা হলো বিশ্বব্যাপী বর্তমান (২০০৮-১৭) দীর্ঘ সময় জুড়েমন্দার প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদের অধুনা প্রজন্মের উত্থান যা প্রায় নয় দশক আগের মহামন্দা কবলিত ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের ঘটনা‍কে মনে করিয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়ন নয়া উদারবাদী অর্থনীতিজনিত সংকট, বৈষম্য ও বেকারির বিপুল বৃদ্ধি, ধান্দার ধনতন্ত্রর অবাধ লুটতরাজ ও ক্রমবর্ধমান জনরোষকে উগ্র দক্ষিণপন্থা বিভাজনের রাজনীতিকে ব্যবহার করে বিপথে পরিচালিত করতে মরিয়া হয়ে পড়েছে।

কর্ণাটকের উদুপিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আয়োজিত ধর্ম সম্মেলনের মঞ্চ থেকে মোহন ভাগবতের ঘোষণা আসলে দেশজোড়া সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও সংঘাতকে তীব্রতর করার মরিয়া আর্তনাদ। এবছর ৬ই ডিসেম্বরের প্রেক্ষাপটে এটাই হলো নবতম সংযোজন। আসলে গুজরাট ও তার পরবর্তী রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনগুলিতে যে কোনও মূল্যে ওঁদের সোনার হরিণ চাই। অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতেই রামমন্দির চাই। যেখানে বাবরি মসজিদ ছিল তার পুরোটাই চাই। সেখানে অন্য কোনও কাঠামো না-থাকা চাই। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকলেও কুছ পরোয়া নেই। রায়ের জন্য অপেক্ষা করা তো দূরের কথা শুনানি শুরু হওয়ার পূর্বেই চাপ সৃষ্টির অসদুদ্দেশ্যে মন্দির নির্মাণের সময়সূচি ঘোষিত হয়েছে। শেষপর্যন্ত কবে কি হয়, হ‍‌বে তা নিয়ে আশঙ্কার কারণ রয়েছে। ৫ বছরে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রত্যক্ষ মদতদাতাদের গুজরাট গণহত্যার নায়কদের কারুর কোনও সাজা হয়নি। গোরক্ষকবাহিনী, অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড, লাভ জিহাদের অভিযোগ তুলে স্বনিযুক্ত খাপ পঞ্চায়েতসহ সঙ্ঘ পরিবারের নানান নামে বিভিন্ন অবতারের নিজস্ব ঘাতকবাহিনী মৃত্যুদণ্ডের রায় দিচ্ছে ও তা কার্যকর করছে। গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ড যে নরেন্দ্র দাভোলকার বা গোবিন্দ পানসারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার পুনর্নির্মাণ মাত্র। কেবল সংখ্যালঘু নয় দলিত, আদিবাসী, অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষ, নারী, শিশু এদের রামরাজত্বে কারুর রেহাই নেই। দেশের সংবিধান, আইনকানুন, বিচারব্যবস্থা, সংসদ, সংবাদমাধ্যম ইত্যাদি কোনও কিছু পরোয়া করার দরকার নেই। রাজ্যসভায় প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোটাই পাল‍‌টে ফেলার অভিযান শুরু হয়েছে। এসব নিছক একনায়কতন্ত্র নয়। কোনও সন্দেহ নেই যে এটা ধান্দার ধনতন্ত্রের বর্তমান পর্বে—লগ্নিপুঁজির সর্বাধিক প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সন্ত্রাসমূলক একনায়কত্বের পথে যাত্রার সূচনা মাত্র। এই একনায়কত্ব আমাদের ভূখণ্ডে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সব চাইতে নির্ভরযোগ্য মিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। এদের হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বাপেক্ষা উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থানের পরিপূরক।

এসবের অর্থ এই নয় যে ভারতে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কায়েম হয়ে গেছে। একটি ফ্যাসিবাদী দলও এককভাবে কেন্দ্রে যদি সরকার গঠন করে তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে তাদের পরিকল্পিত অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাবে যেমনটা এখন হচ্ছে। কিন্তু সেটাই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগঠনের জন্য যথেষ্ট নয়। ভারতে চিরায়ত অর্থে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব যদি তা কোনও সাম্রাজ্যবাদী দেশের ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সামরিক জোটের শরিক না হয়। এসব তাত্ত্বিক বিতর্কের চাইতে নির্দিষ্ট দেশে নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার উপাদানগুলির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের গুরুত্ব বেশি। যে সব দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল, যেমন ইতালি ও জার্মানিতে, তাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের রূপ এক ও অভিন্ন ছিল না। তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিকাশের প্রথম লক্ষণগুলি প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গতিরোধ করতে ব্যাপকতম প্রতিরোধের মঞ্চ গড়ে তোলা। কবে ফ্যাসিবাদ পূর্ণাঙ্গ রূপে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবে তার অপেক্ষায় দিবানিদ্রার বিলাসিতার অর্থ হলো ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করে দেওয়া। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপদ এখনই দরজায় কড়া নাড়ছে। ভারতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান বা বাংলাদেশের চাইতে বেশি। সঙ্ঘ পরিবার ও কেন্দ্রীয় শাসকদলের কল্যাণে আমাদের দেশসহ প্রতিবেশী দুই দেশে আই এস আই এস এবং অন্যান্য মুসলিম সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলির ভিত্তি প্রসারিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, সংঘাত, দাঙ্গার প্রতিটি ঘটনা এদেশে হিন্দুরাষ্ট্রের ধ্বজাধারীদের শক্তি জোগাবে। বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি দুদিক থেকে আক্রান্ত হবে। জাতি, ধর্ম, ভাষার ভিত্তিতে পরস্পরের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত জনগণের জীবন-জীবিকার সংগ্রামে যে জোয়ার সৃষ্টির সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির আর্থিক নীতি ও দুর্নীতির ফলে সৃষ্টি হয়েছে সেগুলি পর্দার আড়ালে চলে যাবে। সেগুলি দমনপীড়নের জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রয়োজন হবে না। তখন নোট বাতিল, জি এস টি, খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, দুর্নীতি ইত্যাদি ইস্যুগুলিকে চাপা দেওয়ার জন্যই ধান্দার ধনতন্ত্রের উপাসকদের রামমন্দির নির্মাণের এই বেপরোয়া তোড়জোড়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যুদ্ধোন্মাদনা সৃষ্টি ষোলকলা পূর্ণ করবে।

সারা দে‍‌শে এখন যা ঘটছে তার বাংলা সংস্করণের প্রকাশ ২০১১ সালে। সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার বিল দিয়ে প্রস্তাবনা — যে জমিতে এখন যে কেউ সরষে ফুল দেখতে পারেন। শিল্পে খরা, কৃষকের আত্মহত্যা, বেকারদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি, টেট থেকে চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি। সর্বোপরি স্বৈরাচার ও সন্ত্রাসের রাজত্বে হামলা, মিথ্যা মামলা, ধর্ষণ, খুন, নির্বাচনে প্রহসন দৈনন্দিন বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। এসবের মধ্যে সঙ্ঘের শাখা ও কর্মতৎপরতা নিরাপদ আশ্রয়ে বিস্তার লাভ করছিল। সীমান্তের ওপার থেকে সন্ত্রাসবাদীরা খাগড়াগড়ে শাসকদলের অফিসের ওপরতলায় ঠাঁই পেল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদী দিল্লির লাড্ডু নিয়ে এলেন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য। প্রতিদানে বি জে পি রাজ্যে আবার ২টি আসন পেল। মুখ্যমন্ত্রী আদাজল খেয়ে নামলেন বি জে পি-কে প্রধান বিরোধীদলের জায়গা করে দিতে। শুরু হলো প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার গড়াপেটা ম্যাচ। ধুলাগড়ে শাসকদলের এক হিন্দু বিধায়ক অপরদিকে এক মুসলমান বিধায়ক টস করে মাঠ ভাগ করে নিলেন। শাসকদলের দুই বিধায়কের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে দুই বামপন্থী সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরি ও মহম্মদ সেলিমের শান্তি মিছিল আটকানো হলো। এরকম অনেক ধুলাগড়, নোয়াপাড়া, বসিরহাট, চোপড়া, ধূপগুড়ির উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। তাই জ্যোতি বসু যাদের অসভ্য বর্বর বলেছিলেন, সেই বি জে পি মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় তাঁদের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ — আগেও ছিল, এখনো আছে। ট্রাম্প, মোদী বা ইনি যে অদৃশ্য সূত্রে সাতপাকে বাঁধা তার পোশাকি নাম ধান্দার ধনতন্ত্র বা ক্রনি ক্যাপিটালিজম। এঁদের সবার স্বামী-স্ত্রী, মেয়ে-জামাই, পুত্র-পুত্রবধূ, ভাই-ভাইপোরা সেই অর্থে একই পরিবারভুক্ত। কেউ বড় শরিক, কেউ মেজো আবার কেউ বা নিতান্তই ছোট শরিক মাত্র। তাই হাস্যকর হলেও এটাই সত্য যে ট্রাম্প যেমন ক্রনি ক্যাপিটালের বিরুদ্ধে প্রকা‍‌শ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন বা মোদী যেমন কালো টাকা উদ্ধারের জন্য চোখ ছলছল করে ফেলেন ইনি তখন রাজ্যে বুথপিছু গড়ে ১০৫ জনের কাজ দিয়ে দিয়েছেন বলে দাবি করতে পারেন। প্রতি ঘণ্টায় ১৫৪জন কাজ পেয়েছেন! পাহা‍‌ড়, জঙ্গলমহল, সুন্দরবন, ডুয়ার্স — সবাই হাসছে তো হাসছেই। এমন কি যাদবপুর, বেহালার পৈশাচিক লালসার শিকার শিশুকন্যার পরিবার, স্বাস্থ্যভবনে বিক্ষোভরত কর্মচারীর মৃতদেহ, ডেঙ্গুতে মৃত বা আত্মঘাতী কৃষকের পরিবার, বন্ধ চা বাগান ও কলকারখানার শ্রমিক কাঁদলেও রাজ্যজুড়ে অট্টহাসির কলরোলের তা এত তুচ্ছাতিতুচ্ছ যে সব চাপা পড়ে যাচ্ছে। হাসাহাসির তালিকা এত দীর্ঘ যে তার স্থান সংকুলান করা এই পরিসরে অসম্ভব। গোয়েবলসীয় প্রচার এখন ‘উত্তর সত্য’ নাম ধারণ করেছে। সংকট জর্জরিত জনগণের সামনে ইন্দ্রজালের কায়দায় সবরকম প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে মিথ্যার মোহজাল নির্মাণের প্রতিযোগিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা।

কেবল এসবের সাতকাহন নিয়ে এবারের ৬ই ডিসেম্বর নয়। এবার ৬ই ডিসেম্বর এসবের বিকল্প নির্মাণের শপথ নেওয়ার দিন। উত্তর সত্যের বিপরীত নির্মাণ। সত্য হলো মার্কিন মুলুকে ট্রাম্পের চাইতে জনসমর্থনের ঢল বার্নি স্যান্ডারস-এর দিকে যিনি সমাজতান্ত্রিক বিকল্পের কথা বলেন। তিনি প্রার্থী হলে ট্রাম্প হয়তো পরাস্ত হতেন। ব্রিটেনে বিরাট জয়ের লক্ষ্য নিয়ে থেরেসা মে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ডাক দিলেন। তাঁর শক্তি ক্ষয় হলো। শক্তি বাড়লো করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টির যিনি টনি ব্লেয়ারের নয়া উদারবাদী নীতির বিরোধী। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বামপন্থীদের সমর্থনে লি পেঁ-কে আটকে দেওয়া গেছে। বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের দ্বন্দ্ব যা এতদিন স্তিমিত ছিল তাতে এখন চিড় ধরেছে। ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া, ইকুয়েডরে বামপন্থীদের জয় জয়াকার। লড়াইয়ের সামনের সারিতে কিউবা। আছে বলিভিয়া, ব্রাজিল। স্পেন, গ্রিস, সাইপ্রাসে বামপন্থীরা এগচ্ছে। আমাদের দেশের রাজধানীতে পার্লামেন্ট স্ট্রিট কার্যত প্রথমে শ্রমিক ও পরে কৃষকরা, সবমিলে ৫দিন দখল নিয়েছিল। রাজ্যে নবান্ন অভিযান বি পি এম ও-র পদযাত্রা, সংগ্রামের নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে। কলকাতা এখন প্রায়শ শ্রমিক, উদ্বাস্তু, আদিবাসী, সামাজিক ন্যায়মঞ্চ লোকশিল্পী, যুব, প্রতিবন্ধী কোনও না কোনও মিছিলে কল্লোলিত হচ্ছে। কিন্তু সামনে অগ্নিপরীক্ষা। ‘তৃণমূল হঠাও বাংলা বাঁচাও, বি জে পি হঠাও দেশ বাঁচাও’ এই আহবান এখন আরও প্রাসঙ্গিক। সংগ্রাম ও সংগঠন গণপ্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত কিনা তার পরীক্ষা দিতে হবে। এবারে ৬ই ডিসেম্বর সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার শপথ দিবস।

গণশক্তি, ৬ই  ডিসেম্বর ২০১৭

No comments:

Post a Comment