20180409

গড়ে তোলো মানুষের পঞ্চায়েত


মিনতি ঘোষ

মহাত্মা গান্ধী স্বপ্ন দেখেছিলেন পঞ্চজনারপঞ্চায়েত অর্থাৎ গ্রাম স্বরাজের কথা। সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে হবে নতুন ভারত গড়ার কাজ। দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে। পরিচালনায় কংগ্রেস দল। বারবার আ‍‌লোচনা হয় দেশ গঠনের, তার উন্নতির জন্য কোন পথে গেলে ভালো হয়। তারপর সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতিতেই স্থান পায় পঞ্চায়েত। আসল সমস্যাতো সেই প্রয়োগের ক্ষেত্রে। জমিদার, জোতদার, উঁচু জাতের (সংখ্যালঘু ধনী ব্যক্তিসহ) প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের দখলে সমষ্টি উন্নয়ন অফিস, (বি ডি ও অফিস) পঞ্চায়েত।
অর্থ যেটুকু সরকার থেকে পাওয়া যেত ভাগাভাগি হয়ে যেত তাদের মধ্যেই। পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ির সামনে একটি কুয়ো অথবা টিউবওয়েল, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সামান্য পাকা রাস্তা, দূরদূরান্তে প্রাইমারি অথবা হাই স্কুল। জেলায় বড়জোর একটি দুটি কলেজ। ধনীর কুয়োর/টিউবওয়েলের জলে অধিকার ছিল না সংখ্যালঘু, আদিবাসী, বাউরি, বাগদিসহ তথাকথিত নীচুজাতের। তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল পুকুর, খালবিল। লেখাপড়ার সুযোগও তাদের ছিল না। বিদ্যুৎ ছিল অধরা স্বপ্ন। সাইকেলও বড়লোকের বাড়িতে। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার চিন্তা গরিব বাড়ির মেয়েদের কমই ছিল। বসন্ত, যক্ষ্মা, কলেরা, ম্যালেরিয়া ছিল নিত্যসহচর।
একদিকে হাতে গোনা সুবিধাভোগী অপর দিকে হাড়-জিরজিরে নিরন্ন মানুষযাদের বান-বন্যা, খরা-শুখা মরশুম অর্থাৎ প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বাঁচতে হতো। স্বাধীনতার আসল স্বাদযখন সাধারণ মানুষ বুঝেছেন তখনই তাঁরা জোট বাঁধতে শুরু করেছেন। তার প্রমাণ মেলে ১৯৬৭, ১৯৬৯ কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র নেতৃত্বে দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের মধ্যদিয়ে। টিকল না দুটি সরকার। ১৯৭১ সালের সি পি আই (এম) নেতৃত্বাধীন জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের সরকার গড়তে দেওয়া হয়নি। সারা দেশে জনবিরোধী কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠেছে। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলো। ঠিক আজকের মতো গণতন্ত্রকে হত্যা করা হলো, বাক্‌স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হলো। আমাদের রাজ্যে এগারোশো কর্মীকে খুন করা হয়েছে। শহীদের তালিকাতে সিংহভাগই গরিব, দলিত, সংখ্যালঘু মানুষ। সীমাহীন অত্যাচারের শিকার মহিলারা।
১৯৭৭ সালে আবার নির্বাচন। এরাজ্যে সি পি আই (এম) সর্বাধিক ভোট পেয়ে গঠন কর‍‌ল বামফ্রন্ট সরকার। কেন্দ্রে জনতা সরকার।
পরিবর্তনের ভরকেন্দ্রে কিন্তু অগণিত গরিব কৃষক, মধ্যবিত্ত, মহিলা, বেকার যুবক। তাঁরা কংগ্রেস সরকারের অপশাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। সেই ভূমিহীন কৃষক যাঁরা যুক্তফ্রন্টের আমলে স্লোগান দিয়েছিলেন—‘লাঙল যার জমি তারনেতৃত্বে সারা ভারত কৃষকসভা। কৃষক রমণী ছিলেন তাঁদের সাথি।
ওপরের কথাগুলো হয়তো ‘‘ধান ভানতে শিবের গীত’’ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু মানুষইতো বামফ্রন্ট সরকার গড়ল। তাঁদের দীর্ঘকালের বিশ্বাস লালঝান্ডা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। করেও ছিল। সরকার গঠনের পরই সিদ্ধান্ত করে ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে বাস্তবে কার্যকর করেছে। এতদিন গরিব মানুষের মাথার উপর কোনও ছাদ ছিল না। এবার তারা সেই নির্ভরতার জায়গাটা খুঁজে পেল। বামফ্রন্ট যার নেতৃত্বে সি পি আই (এম) তাঁদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। নির্বাচনী প্রতিটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিতে চলার ফলে। মূল মিত্রকে চিনে নিতে তাই কোনও পক্ষেরই ভুল হয়নি।
ভূমিসংস্কারের সাফল্য : ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকার প্রায় ১৪ লক্ষ ৪ হাজার ৯১ একরের বেশি জমিকে খাস করেছে। কৃষিযোগ্য জমি ১৩ লক্ষ ১৪ হাজার একরের বেশি। ভূমিসংস্কারের ফলে বিলি হওয়া পাট্টার ৫৫ শতাংশ তফসিলি জাতি ও আদিবাসী মানুষ পেয়েছেন। সংরক্ষিত নন অথচ সংখ্যালঘু মানুষের ৩৬.২৪ শতাংশ মানুষ জমি পেয়েছেন।
এরাজ্যে গড়ে যদিও ২৭ শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষ বাস করেন।
মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন বলছেরাজ্যে ৫৮.৭ শতাংশ থেকে ৭২.৬ শতাংশ তফ‍‌সিলি জাতি প্রধান ব্লক রয়েছে ১২টি। বেশিরভাগই জলপাইগুড়ি, বাকিটা মালদহ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। তফসিলি উপজাতি ৪১.৩ শতাংশ থেকে ৫১.৫ শতাংশ প্রধান ৭টি ব্লক। ৩১.০ শতাংশ থেকে ৪১.৩ শতাংশ ৯টি ব্লকে। এমনভাবেই সারা রাজ্যে কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় তাঁরা সীমাবদ্ধ নেই। সংখ্যালঘু মানুষের বাস সবচেয়ে বেশি মুর্শিদাবাদ ও মালদহে। প্রায় ১০ কোটি মানুষের বাস পশ্চিমবঙ্গে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, ভাষাভাষী, সংস্কৃতিগত বৈচিত্রের মধ্যেও তাঁদের অবস্থান। একারণেই উন্নয়ন বা অনুন্নয়নের নিরিখে কোনও জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে চিহ্নিত করা যায় না।
প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ১২ লক্ষের বেশি মানুষ বর্গাদার হিসাবে নথিভুক্ত হলো। বাস্তুজমি পেয়েছেন ২.৭৭ লক্ষ মানুষ।
প্রথম বামফ্রন্ট আমলে গ্রামবাংলার জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিগুলি রূপায়িত হয়েছিল তার জন্য ছিল : ১৯৭৭২৯শে সেপ্টেম্বর : বিধানসভায় পশ্চিমবঙ্গ ভূমিকা (সংশোধনী) বিল গৃহীত। ১৯৭৭৭ই নভেম্বর : ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের দিনই ঘোষণা করা হলো—‘‘চাষ করবেন যিনি, ফসল নেবেন তিনি’’১৯৭৭১৮ই নভেম্বর : ‘‘বর্গাদারদের নাম নথিভুক্তকরণের আইনগত ভিত্তি সম্পর্কে গাইড লাইন প্রকাশ করে বামফ্রন্ট সরকার। যুগান্তকারী এই সিদ্ধান্ত আমূল পালটে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের চেহারা। মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে মহিলাদেরএকক পাট্টা পেয়েছেন ১ লক্ষ ৬২ হাজার ৮৩৭ জন মহিলা। যৌথ পাট্টা৬ লক্ষ ৩ হাজার ৯৮৭টি পরিবার।
এটা কোনও মামুলি খতিয়ান নয়। সরকার গঠনের পর একটি সিদ্ধান্তরূপী মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দিশাকে সামনে রেখে এগিয়ে চলার শপথের নামই বামফ্রন্ট সরকার। যা আজ তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ভুলিয়ে দিতে চাইছে, যে তৃণমূলের জন্ম হয়েছিল কংগ্রেসের মধ্যে থাকা হিংস্র একটি অংশকে নিয়ে। দেশি, বিদেশি বামবিরোধী শক্তি, কর্পোরেটদের একটি অংশ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক শক্তির একটি বড় অংশ ৩৪ বছরের বাম-সরকারকে হটিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদসহ আদর্শহীন একটি দলকে সরকার গঠনে সাহায্য করেছে। গরিব নিম্নবিত্ত মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মাঝেই ১৯৭৮ সালে বাস্তুঘুঘুর বাসা ভেঙে দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন হলো। জিতলেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষ, অসংরক্ষিত পদে দুশোর মতো মহিলা।
একদিকে গ্রামবাংলায় এই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে প্রবল ভূমিকম্পে সব ওলট পালট হয়ে গেল। ওধারেরমানুষের হাতের ক্ষমতা এধারেরঅগণিত মানুষের হাতে এসে গেল। এর মাঝেই ১৯৭৮-এর বিধ্বংসী বন্যার মুখোমুখি সরকার। পঞ্চায়েত সরকার ও মানুষের মাঝে সেতু বন্ধনের কাজ করল; ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, ৮১৩ জনের মৃত্যুর হাহাকারের মধ্যেও ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে।
পঞ্চায়েত হলো ভরসার জায়গা। তখনতো মুখ্যমন্ত্রী সাঙ্গোপাঙ্গ, মন্ত্রী, আমলাদের নিয়ে জেলা চষে বেড়াতেন না। একহাতে সব দপ্তরও সামলাতেন না। নীতি নির্ধারণ করবে মন্ত্রীসভা। তদারকি করবেন প্রশাসক।
প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসুর নির্দেশ ছিলগ্রামের একজন নেংটিপরা মানুষকে আপনি বলা, থানা বা সরকারি অফিসে গেলে চেয়ারে বসতে দেওয়া। এই শ্রেণিচেতনার সাথে আজকের ফারাক সহজেই অনুমেয়।
পঞ্চায়েতের বিরাট সাফল্য তুলে ধরা সম্ভব নয়। ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েত গ্রামবাংলার চেহারা বদলে দিয়েছে। সমবায়, ল্যাম্পস, সেচ, বিদ্যুৎ, পাশাপাশি বীজ, মিনিকিট বিতরণ, খেতে না পাওয়া মানুষের জন্য কাজের বদলে খাদ্যকর্মসূচি সহায়তা দিয়েছে গরিব মানুষকে। আজকের মতো টাকা লুট হয়নি। বখরা নিয়ে প্রকাশ্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামনে আসেনি। কারণ ৩৪ বছরে গ্রামের মানুষের ধারাবাহিক অর্থনীতির পরিবর্তনের ফলে ৪০ হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারই ধাপে ধাপে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছে। দরিদ্রতম ঘরের সন্তানেরা স্কুলে গিয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ছাত্র থেকে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। আজও সেই ধারা অক্ষুণ্ণ আছে। ধাপে ধাপে নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে উন্নয়নের কোনও চোখ ধাঁধানো প্রচার ছিল না। জনগণের সরকার একটি অঙ্গরাজ্যে সীমাবদ্ধ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে দাঁড়িয়ে কাজ করেছে। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অস্বাভাবিক যা তা হলো পুরানো সমস্ত সাফল্যকে নষ্ট করে অথবা নিজের বলে আত্মসাৎ করা। সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এক দপ্তরের অর্থ অন্য দপ্তরে খরচ করে লাগামহীন উৎসব, মেলা, খেলা, ক্লাবের মধ্যদিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করা। মস্তানবাহিনী তৈরি করে গ্রামের নব্যধনী, তোলাবাজ, সিন্ডিকেটরাজ, প্রশাসনের একটি বড় অংশকে যুক্ত করে ভোট লুট করা। নিয়মনীতি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারভিউ দিয়ে যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা কাজ পাচ্ছে না।
বেলাগাম একটি সরকার চলছে। ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে বি জে পি-র নেতৃত্বে চলা কেন্দ্রীয় সরকার সংগত করে চলেছে। দুটি দলই আদ্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। ধর্মীয় মেরুকরণের পৃষ্ঠপোষক। দেশের পক্ষে ভয়ংকর বিপদ বি জে পি এবং তৃণমূল।
এরাজ্যে শিল্প, কলকারখানা বন্ধ অথবা বন্ধের মুখে। নতুন কোনও শিল্প স্থাপন হয়নি। কৃষিক্ষেত্রে ভয়ংকর সংকট। নজিরবিহীনভাবে এরাজ্যে কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। সারা দেশের মধ্যে নারী নির্যাতনে শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। দুকোটি আর দশলক্ষ বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি কেন্দ্র, রাজ্য সরকারের ফাঁকা আওয়াজ। ভোটের আগে ধর্মের জারক রসে এরাজ্যের মানুষকে জারিত করছে। যার সবচেয়ে বড় শিকার মহিলারা। বামফ্রন্ট সরকার মর্যাদা দিয়েছিল নারী, আদিবাসী, তফসিলিদের। নারী সুরক্ষার অন্যতম শর্ত সমাজের সব ক্ষেত্রেই সমান মর্যাদা নিয়ে মহিলাদের উপস্থিতি। লোকসভা, বিধানসভায় এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের দাবিতে প্রগতিশীল মহিলা সংগঠনগুলি আন্দোলন করে আসছে। ৭৩তম সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত হয়।
তার বহু পূর্বেই এরাজ্যে মহিলা, তফসিলি, আদিবাসী পেছিয়ে পড়া এই তিন অংশের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়। ধীরে ধীরে পদাধিকারী সংরক্ষণ-এর মধ্য দিয়ে তাঁদের প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার। এই যুগান্তকারী পরিবর্তন কোন মামুলি বিষয় নয়। যার ফলে   পথেঘাটে, অফিসে, স্কুল কলেজে, খেতখামার, ব্যাঙ্ক, আদালত সর্বত্র মহিলাদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ। অসংখ্য কাজের সুযোগ সংগঠিত, অসংগঠিত ক্ষেত্রে। আই সি ডি এস, আশা, এস এস কে, এম এস কে, মিড ডে মিল থেকে বিড়ি, দড়ি, তাঁত কত যে কাজ সৃষ্টি হয়েছিল। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মধ্যদিয়ে ১ কোটি নিরক্ষর অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মহিলা উৎপাদনের কাজে যুক্ত হয়েছেন। নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে বাঁচার প্রেরণা বামফ্রন্ট সরকার দিয়েছিল।
আজ শুধু উন্নয়নের ঢক্কানিনাদে সাধারণ মানুষ বিমূঢ়। ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট সরকার অর্থনীতির যে দৃঢ় বনিয়াদ তৈরি করে গিয়েছে তার উপর দাঁড়িয়ে সৌন্দর্যায়ন, উপরিকাঠামোর রং বদলমাত্র। ভেতরে পোড়া ছাই। তাই গণতন্ত্র হত্যা, বাক্‌স্বাধীনতা স্তব্ধ করে দেওয়া, হামলা, মামলা, মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে জেলে পাঠানো, প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে দখলের রাজত্ব চলছে।
নব্বইয়ের দশক থেকে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির আক্রমণের সাথে মানুষের মনোজগৎকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ তলানিতে। মিডিয়ার অবিরাম প্রচার সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, একটা সাময়িক উচ্ছ্বাসের মধ্যে রেখে দেওয়া আজকের কর্পোরেট মিডিয়ার মূল লক্ষ্য। চা বাগিচায় মৃত্যু মিছিল, ডিজিটাল রেশন কার্ডের নামে প্রকৃত প্রাপকের নাম বাতিল। বিধবাভাতা, বার্ধক্যভাতা পাচ্ছেন না গরিব মানুষ। ১০০ দিনের কাজ ৩২ দিনে নেমেছে। মজুরি অনিয়মিত। ইন্দিরা আবাস যোজনায় ব্যাপক দুর্নীতি। আমাদের করের টাকায় যে প্রকল্প আসছে তার নাম বদলে নিজের বলে চালানোর মতো অনৈতিক কাজ এ সরকার করে চলেছে। সর্বত্র একটি চকচকে মুখের ছবি বদলে যাচ্ছে অবিরত। তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরকে বাধ্য করছে মকর সংক্রান্তির দিন লোকশিল্পীদের মঞ্চে এনে (সবাই প্রকৃত শিল্পী নন) সরকারের বন্দনা গাইতে। নগদ মজুরি, ব্যাঙ্কে ১০০০০০ টাকা রাখা।
সর্বত্র ব্যক্তিগত উপভোক্তা তৈরি করে চলেছে এই সরকার।
এই অবস্থা বেশিদিন চলে না। স্বৈরতন্ত্র একদিন পরাস্ত হবে‍‌ই। একনায়কতন্ত্রীদের একদিন মানুষ ছুঁড়ে ফেলে দেবেনই। কন্যাশ্রীর ২৫ হাজার টাকা, ‘সবুজসাথীরসা‍‌ইকেল, ‘খাদ্যসাথীর রেশনে পচা চাল সরবরাহ, রূপশ্রীর মধ্যদিয়ে কন্যার রূপ আর তার শেষ পরিণতি বিবাহনামক পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলার চক্রান্ত, বিউটি পার্লারের আরও বেশি অর্থ অনুমোদন, রাস্তার ধারের মদের দোকান খোলার অনুমোদন, হাজার হাজার শিলান্যাস মানুষের মস্তিষ্ককে এলোমেলো করে দিচ্ছে। ঠিক-বেঠিক হারিয়ে যেতে বসেছে। ভোগবাদী পণ্য সংস্কৃতি আজ গ্রাস করছে সমগ্র সমাজকে। যে কোনও মূল্যে নিজের ভালো চাই।
আমাদের লড়াই ‘‘আমরার’’ লড়াই। আমাদের লড়াই রাজ্য বাঁচানো, দেশ বাঁচানো, শ্রমজীবী মানুষের চুরি হয়ে যাওয়া অধিকার ফেরত পাবার লড়াই। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভয়ংকর ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে আমাদের মূল স্লোগান ‘‘বি জে পি হটাও, দেশ বাঁচাও, তৃণমূল হটাও রাজ্য বাঁচাও’’-এর সাথে দুটি শক্তিই যে একে অপরকে সাথি করে এরাজ্যে মানুষকে বোকা বানাতে চাইছেতা বোঝানো।
আমরাই পেরেছিলামআমরা পারবএই প্রত্যয় নিয়ে আমাদের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
তথ্যসূত্র: ফিরে দেখাবুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
লুঠের পঞ্চায়েতঅধিকার পুনরুদ্ধারের লড়াই

গণশক্তি, ৪ঠা এপ্রিল ২০১৮

No comments:

Post a Comment