20180107

এফ আর ডি আই বিল:রাজকোষ হতে চুরি...


জয়দেব দাশগুপ্ত

বাংলা ১৩০৬ সালে মানে আজ থেকে ১১৭ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিশোধনামে একটি কবিতা লেখেন। শিরোনামে পঙ্ক্তিটি দিয়ে কবিতার শুরু। কিন্তু পাঠক দেখুন, রাজকোষ থেকে অর্থ তছরূপ বা চুরির হদিশ বা কে চোর তা কবি লেখেননি। শুরু থেকে কবিতা অন্য প্রবাহে চলতে শুরু করল। এক অনবদ্য সৃষ্টি হয়ে রইলো কবিতাটি যা আজও আমাদের মুগ্ধ করে।
রাজকোষ বা Treasury থেকে চুরি কে করতে পারে তা যে কোনও নাগরিক বিলক্ষণ বুঝতে পা‍‌রেন। যার ক্ষমতা আছে, যে বা যারা জানে তাদের কোনও শাস্তির মুখে পড়তে হবে না। আজকের সরকারের বদান্যতায় বড় বড় ব্যবসায়ীরা সরকারি অর্থ নিয়ে ব্যবসা করে, ব্যবসাকে বাড়িয়ে, এক ব্যবসার জন্য অর্থ নিয়ে অন্য নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে, বিশ্ব ধনকুবেরদের তালিকায় নাম তুলে দেশের গরিব মানুষদের কৃতার্থকরে দেশের মুখ উজ্জ্বলকরছে। কিন্তু টাকা যা ধার নিয়েছে তা ফেরত দিতে তাদের প্রচণ্ড অনীহা। এদের প্রত্যেকের নাম ব্যবসা সরকার জানে। কিন্তু প্রকাশ করলে এদের ভাবমূর্তিতে যে আঘাত লাগবে তাতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার খুবই বিব্রত হবে। তাই সরকার অর্থমন্ত্রক খুবই ধৈর্যশীল। এবার তাদের কথায় আসা যাক। কারণ কোষাগারের পয়সা বা ব্যাঙ্কের টাকা তো সাধারণ মানুষের। তারা বিশ্বাস করে সরকারি ব্যাঙ্কে টাকা রেখেছেন। সেই টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ দিয়েছে। টাকা ফেরত না এলে গরিবরা বিপদে পড়বে, দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, পরিকাঠামোর উন্নয়ন থমকে যাবে, কৃষিঋণ কমবে, অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া বন্ধ হবে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবকরা ছোট/মাঝারি ব্যবসায় ঋণ পাবেন না, যা সারা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। আমাদের দেশ নানা সংকটে জর্জরিত কিন্তু এই অভাবনীয় সংকট, বড় বড় কোম্পানিগুলো ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়ে টাকা ফেরত দেবে না আমরা মানবো কেন?
১৯৯৮ সাল জ্যোতি বসু
দশকে তিনটি ব্যাঙ্ক দুর্বলবলে ঘোষণা হয়। কারণ ছিল একই। কলকাতায় সদর দপ্তর এমন দুটি ব্যাঙ্ককে CII (Confederation of Indian Industry) চরম সংকটে পড়েছে বলে গ্রাহকদের পরামর্শ দেয় ব্যাঙ্কগুলিতে টাকা রাখা নিরাপদ নয়। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিবৃতি দিয়ে বলেন CII- ভূমিকা চরম নিন্দনীয়। রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কে টাকা রাখা নিরাপদ, সুতরাং কোনও ভয় নেই। একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র একটি ব্যাঙ্কের সদর দপ্তরের ছবি ছাপিয়ে গ্রাহকদের টাকা তুলে নিতে প্ররোচনা দেয়। তবুও কোনও মানুষ টাকা তুলে নেননি। প্রয়াত জ্যোতি বসুর এই অবদান চিরকাল মনে রাখবো।

ব্যাঙ্কগুলি রুগ্নয়, শক্তিশালী
২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির আমানত ৮১ লক্ষ কোটি টাকা, ঋণদান ৫৬ লক্ষ কোটি টাকা, বিনিয়োগ প্রায় ২৬ লক্ষ কোটি টাকা। আমানত সংগ্রহ প্রমাণ করে দেশের সাধারণ মানুষ সরকারি ব্যাঙ্ককে শুধু ভরসাই করে না, আস্থাও অটুট। সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগী, ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক, গরিব, মধ্যবিত্ত, অসংগঠিত শ্রমিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে টাকা রেখে নিশ্চিন্ত। কোনও বিদেশি ব্যাঙ্ক গত ২৬ বছরে সরকারি ব্যাঙ্কের উপর মানুষের বিপুল আস্থায় চিড় ধরাতে পারেনি। সরকারি ব্যাঙ্ক, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, সমবায় ব্যাঙ্ক সরকারি, বিদেশি নানা বিধান, বিধিনিষেধের মধ্যেও বিপুল অগ্রগতি ঘটিয়েছে।
আসলে ব্যাঙ্কের রুগ্ণতা জন্য দায়ী দেশের বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি যারা সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। এর পরিমাণ সরকারি হিসাবেই লক্ষ কোটি আমাদের হিসাবে ১৭-১৮ লক্ষ কোটি টাকা। পুরানো দিনে রেল বাসে বিজ্ঞাপন দেখা যেত সরকারি সম্পত্তি-আপনার সম্পত্তি। কথাটি বাস্তবে প্রয়োগ করেছে দেশের কয়েক‍‌টি পরিবার। তারা সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়েছে, ব্যবসা করেছে, ব্যবসা বাড়িয়েছে, একটি ব্যবসার জন্য টাকা নিয়ে অন্য ব্যবসায় খাটিয়েছে, বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় নাম তুলেছে কিন্তু সরকারি ব্যাঙ্কের বকেয়া টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। সরকার নির্বিকার। নানা আইন, আইনের সংশোধন, নতুন আইন প্রনয়ণ কিন্তু এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলি সাড়ম্বরে ব্যবসা করে চলেছে। ব্যাঙ্ক রুগ্দেশের সাধারণ মানুষ দারিদ্রে পীড়িত কিন্তু এরা বিপুলাকার। এখনই এদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য মামলায় গ্রেপ্তার করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা দরকার। তাহলেই রুগ্ এই বিশেষণ থাকবে না।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা ব্যস্ত অন্য কাজে। কোনও মানুষ কি খাবে, কি পরবে, কেমনভাবে ধর্ম পালন করা উচিত, সংবিধান কেন ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি থাকবে এসব অতি প্রয়োজনীয় বিষয়নিয়ে গভীর চিন্তা কাজে নিমগ্ন। সুতরাং সময় কোথায়? তবুও যেটুকু সময় বার করা গেছে গত সাড়ে তিন বছরে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে জিনিসের দাম বাড়ছে, সরকারি সম্পত্তি বেচা হচ্ছে, গোরক্ষকরা সমাজরক্ষকের ভূমিকায় এবং পরিশেষে এফ আর ডি আই ব্যাঙ্কের সমস্ত গ্রাহকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।

কিছু তথ্য এবং বাস্তবতা
২১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, ৫৬‍‌টি গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, ৩১‍‌টি রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্ক, ৩৭০‍‌টি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক, ১৬০৬টি শহরাঞ্চলীয় সমবায় ব্যাঙ্ক এবং ৯৩,০০০টি প্রাথমিক কৃষি ঋণদান সমিতি নিয়ে ব্যবস্থা। শক্তিশালী এই ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের স্বার্থে ধারাবাহিক কাজ করে চলেছে। অন্যদিকে ৫৫৯টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ২৫টি বেসরকারি ব্যাঙ্কের দায়িত্ব ১৯৬৯ সালের পর থেকে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি গ্রহণ করেছে আমানতকারীদের স্বার্থে। ১৯৬৯ সালে আমানত ঋণ নিয়ে ব্যাঙ্কগুলির মোট ব্যবসা ছিল ৯০০০ কোটি টাকা। যা আজকে ১৪০ লক্ষ কোটি টাকা।
এবার আসা যাক ঋণ খেলাপিদের কাছে ব্যাঙ্কের পাওনা ২০০৪ সালে ৪৮০০০ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ,৯৪,০০০ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ সালে ,১১,০০০ কোটি টাকা, ২০১৭-এর সেপ্টেম্বর ,০০,০০০ কোটি টাকা।
মাত্র ৫০০টি অ্যাকাউন্টে ,০০,০০০ কোটি টাকা সরকারি হিসাবেই ব্যাঙ্কগুলি পাবে। অর্থমন্ত্রকের হিসাবে মাত্র ১২‍‌টি চিহ্নিত কোম্পানি থেকে ব্যাঙ্কগুলির পাওনা ,৬০,০০০ কোটি টাকা। এই টাকা আদায়ের দায়িত্ব কার? ব্যাঙ্কের বোর্ডগুলির যার এই ঋণ মঞ্জুর করেছে, সরকারের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যাদের তত্ত্বাবধানে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি চলে।
২০১৫ সালে ব্যাঙ্কগুলি মোট লাভ করেছে ,৩৮,৭০০ কোটি টাকা, নিট লাভ ৩৭,০০০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ব্যাঙ্কগুলির মোট লাভ ,৩৭,৩০০ কোটি টাকা, নিট লোকসান ১৮,৬৭০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ব্যাঙ্কগুলির মোট লাভ ,৫৯,০০০ কোটি টাকা, নিট লোকসান ১১,০০০ কোটি টাকা।
তাহলে প্রশ্ন আসবে মোট লাভ হলে নিট লোকসান কেন হয়। ঋণ খেলাপিদের জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে Balance Sheet- Provision (অর্থাৎ ঋণ খেলাপিদের জন্য বন্দোবস্ত বা অর্থের সংস্থান) করতে হয়। যার জন্য উপরোক্ত তিনটি বছরে ব্যাঙ্কগুলিকে সংস্থান করতে হয়েছে ২০১৫ সালে ,০০,৯০০ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ,৫৫,৯৭০ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ,৭০,০০০ কোটি টাকা। দায় কার?
যে ঋণ আর ব্যাঙ্কে ফিরবে না বা বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলিকে ফেরত দিতে হবে না তা Balance Sheet থেকে মুছে ফেলা হয়েছে write off এর মাধ্যমে। কত টাকা একবার দেখুন : ২০০৫-২০১৪ মোট ,৪৬,৯০০ কোটি টাকা, ২০১৫ ৪৯,০০০ কোটি টাকা, ২০১৬ ৫৭,৪০০ কোটি টাকা, ২০১৭ ৮১,৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত তিন বছরে প্রায় ,৮৮,০০০ কোটি টাকা। সাধারণ আমানতকারীদের টাকার এমন কর্পোরেট হরির লুটআমরা দেখছি। অথচ সরকার, সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিনমাধ্যম দিক‍‌টি সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে না। এবার এর সমস্ত দায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ আমানতকারীদের সঞ্চয়ের উপর।

মানুষের অর্থ সঞ্চয় দেশের অগ্রগতি
আপনি যদি ৫০০০ টাকা নিজের কাছে রাখেন বা ঘরে রাখেন তবে তা নিরাপদ কিন্তু যদি ব্যাঙ্কে রাখেন তবে তা নিরাপদ থাকবে না কোন আইন? যে কোনও নোটের উপর ( টাকা বাদে) রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের আশ্বাস থাকে। যা সরকার কর্তৃক গ্যারান্টি। আপনি ৫০০০ টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে কিছু সুদ পাবেন (যদিও সুদের হার ধারাবাহিকভাবে কমছে) কিন্তু আপনার মতো কোটি কোটি গ্রাহক ব্যাঙ্কে টাকা রাখছে বলেই দেশের অগ্রগতি সম্ভব হচ্ছে। দেশের পরিকাঠামোর উন্নয়ন, শিল্প ব্যবস্থার অগ্রগতি, গরিব মানুষের ঋণ প্রদান, বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের যেটুকু বন্দোবস্ত তা করা সম্ভব হয়েছে। কিছু বিশাল ধনকুবের ব্যাঙ্কের টাকা চুরি করলে তার খেসারত সাধারণ গ্রাহকদের দিতে হবে কেন? যে ধরনের আর্থিক ব্যবস্থা সমস্ত পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তার নির্মম রূপ এই বিলের মধ্যেই আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সরকারি ব্যবস্থা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ওরা গ্রাহকদের বাজারি জুয়ার অর্থ ব্যবস্থার মধ্যে ঠেলে দিতে চাইছে। আমরা সবাই একত্রিত হলে এই ভয়ংকর আইনকে রুখে দিতে পারবো।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর এক ডেপুটি গভর্নর
যাদের হাতে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ভার সেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর সাহেবের নিদান এত সরকারি ব্যাঙ্কের দরকার কি? যেন ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমলেই বড় বড় ঋণ খেলাপিরা লাইন দিয়ে এসে বকেয়া টাকা ফেরত দিয়ে যাবে। তার ডেপুটি আরও সরেস, তার নিদান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির পুনরায় বেসরকারিকরণ প্রয়োজন। অর্থাৎ চাকা ঘোরাতে হবে : বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ১৯৬৯ এবং ১৯৮০ সালে সরকারি ব্যাঙ্ক আবার ফিরে যাও ১৯৬৮ সালে। আসলে যবে থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার কেন ব্যবসা করবে? ব্যবসা করবে ব্যবসায়ীরা তবে থেকেই এই বিপদ। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করলে দেশের মানুষের লাভ হবে? দেশের সরকার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সমস্ত সরকারি ক্ষেত্রকে ধ্বংস করে সে জায়গায় লটেরাদের রাজত্ব কায়েম করতে চায়।

এফ আর ডি আই বিল ২০১৭
এই বিলে হঠাৎ আসেনি। ১৯৯১ এর পর থেকে (সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বিপর্যয়ের পর) একের পর এক কমিটি গঠন করে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে কোণঠাসা করতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকারের নিরলস প্রয়াস সফল হয়নি। বরং ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা বেড়েছে। সম্প্রতি পি জে নায়েক কমিটির সুপারিশ, বর্তমান নরেন্দ্র মোদী সরকারের জ্ঞান সঙ্গম-এবং জ্ঞান সঙ্গম-’, ‘ইন্দ্রধনুষপ্রকল্প, ‘বিচার মন্থননানা গালভরা নামের আড়ালে লক্ষ্য ছিল একটাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ। যেন ব্যাঙ্কের শীর্ষপদ চেয়ারম্যানের নাম বদল করে ম্যানেজিং ডিরেক্টর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার করলেই ব্যাঙ্কগুলি ঘুরে দাঁড়াবে। যত কমিটির যত সুপারিশ জমা পড়েছে ততই সরকারি ব্যাঙ্কের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পুঁজিপতি গোষ্ঠীগুলি চুরি করেছে। অনুৎপাদক সম্পদ পোশাকি নাম NPA (Non Performing Assets) বেড়েছে। সরকারি ব্যাঙ্কের শেয়ার বাজারে বেচা হয়েছে সরকারি ব্যাঙ্কের বোর্ডগুলিতে শেয়ার বাজারের দালালেরা স্বমহিমায় বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যাঙ্কগুলি বড় বড় শিল্পপতি গোষ্ঠীগুলিকে লাগামহীন ঋণ দিয়েছে কমে গেছে অগ্রাধিকার ক্ষেত্রের ঋণ, চাষি সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ না পেয়ে মহাজনের কাছে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে আর অন্যদিকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সাত-আটটা ব্যাগ নিয়ে এক শিল্পপতি বেসরকারি বিমানে চে‍‌পে সাগর পাড়ি দিয়ে লন্ডন চলে গেছেন। কি অদ্ভুত বৈপরিত্য!
সাধারণ মানুষ নোট বাতিলের সময়ে নিজের টাকা ফেরৎ নিতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ১০০ জন মানুষ মারা গেলেন ১০ জন ব্যাঙ্ক কর্মচারী কাজের চাপে মারা গেলেন কিন্তু সরকার নির্বিকার। কালো টাকা উদ্ধার, সন্ত্রাসবাদীদের হাতে অর্থ যাওয়া বন্ধ করা, জাল নোট উদ্ধার করার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরিণতি যত নোট বাতিল হয়েছিল তার ৯৯ শতাংশই আবার ফিরে এসেছে এখনও ১৪ মাস ধরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক টাকা গুনে চলেছে নতুন ছাপানো নোট দুমাসের মধ্যে জাল হয়েছে সন্ত্রাসবাদীরা তাদের কার্যকলাপ নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছে যে কালো টাকা ছিল তা ব্যাঙ্কের কাউন্টারে জমা পড়ে সাদা হয়েছে। উপরন্তু নতুন নোট ছাপাতে ৭০০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হয়েছে।
এখন আবার নতুন বিল এফ আর ডি আই ফিনানসিয়াল রেজোলিউশন এন্ড ডিপোজিট ইনসিওরেন্স বিল-২০১৭। বছর জুন মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা এই বিল অনুমোদন করে সংসদে পেশ করে। এই বিলের বিরুদ্ধে বছর জুলাই মাসে আমরা বিবৃতি দিয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। সবার প্রতিবাদের ফলে নরেন্দ্র মোদীর সরকার সংসদের যুক্ত কমিটির কাছে বিলটি পরীক্ষার জন্য পাঠায়।
এই বিলের ১৪৭ পাতা জুড়ে নানা বিধান দেওয়া হয়েছে যেন ব্যাঙ্কের রুগ্ণতা জন্য দায়ী সাধারণ গ্রাহক আমানতকারী। সবচেয়ে বিপদজনক দিক হলো এই বিল আইনে পরিণত হলে একটি রেজো‍‌লিউশন কর্পোরেশন গঠিত হবে যার হাতে থাকবে দানবীয় ক্ষমতা।
() যে কোনও ব্যাঙ্ক, বিমা সংস্থা, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, সমবায় ব্যাঙ্ককে সংযুক্তিকরণ, দেউলিয়া ঘোষণা বা চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারবে।
() সেই সংস্থায় গ্রাহকের সঞ্চিত অর্থ ফেরত না দেওয়ার সিদ্ধান্ত, মেয়াদি আমানতের সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বা সেই সংস্থার শেয়ার ইক্যুইটি সঞ্চিত অর্থের বদলে নিতে বাধ্য করা।
() এই কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত কোনও সরকারি প্রশাসনিক সংস্থা বিরোধিতা করতে পারবে না বা আদালতে বিচারের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না।
() কিছুদিন আগে একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল অতি সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত একটি ব্যাঙ্কের শীর্ষস্থানীয় কর্তা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, ব্যাঙ্কে টাকা রেখে সারা জীবন সুদ পাওয়ার ইচ্ছা ছাড়তে হবে। সুদের হার ধারাবাহিকভাবে কমছে তবুও কেন মানুষ ব্যাঙ্কে টাকা রাখছেন। তারা শেয়ার বাজারে বা মিউচ্যুয়াল ফান্ডে টাকা জমা রাখুক বা সোনা কিনুক।
সত্য কথাটি হলো সরকার আর কোষাগার থেকে ব্যাঙ্কগুলিকে টাকা দিতে চাইছে না। সরকার অতি সম্প্রতি ১১টি সরকারি ব্যাঙ্ককে শর্তাধীনে টাকা দিয়েছে। এবার গ্রাহকের সঞ্চিত অর্থের ওপর নজর পড়েছে সরকারের ওখান থেকেই টাকার জোগান দিয়ে রুগ্ব্যাঙ্কগুলিকে টাকার বন্দোবস্ত করা যার পোশাকি নাম বেল-ইন।
যে কয়েকটি পরিবার সরকারি ব্যাঙ্কগুলি থেকে সরকারি হিসাবেই লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ করল তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে গেলে সরকারের পতন হবে, তাই উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত এই বিধান।

মুক্ত করো ভয়...
সারা ভারতের ১০ লক্ষ ব্যাঙ্ক কর্মচারী এই বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। চলছে সই সংগ্রহ স্পিকারের কাছে জমা পড়বে কোটি কোটি গ্রাহকের আবেদন। ২৪শে জানুয়ায়রি ২০১৮ সারা ভারতে আমাদের ফেডারেশনের ডাকে ধরনা-অবস্থান হবে, রাস্তায় বসে ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা সই সংগ্রহ প্রচার করবেন।
গত ২৬ বছরে ৫৬টি ধর্মঘটের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা সরকারের বিভিন্ন অপপ্রয়াস জনবিরোধী সিদ্ধান্তের মোকাবিলা করেছেন। তাই ভয় পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। সরকারি ব্যাঙ্ক  দেশের আপামর জনতার। এই ব্যবস্থা থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা সরকারের নেই। লড়াই হবে রাজপথে, রাস্তায়, গ্রামে, শহরতলিতে। টাকা রাখবো ব্যাঙ্কেই। টাকা যারা চুরি করেছে তাদের কঠোরতম শাস্তি চাই। সরকারি ব্যাঙ্কের আমানত জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হোক, গরিব মানুষকে কম সুদে ঋণ দেওয়া হোক, যথার্থ পরীক্ষা করে বড় বড় ঋণগুলি দেওয়া হোক।
রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র আমাদের এই ক্ষেত্র থেকে আমাদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে না।  
 
(লেখক ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন, পশ্চিমবঙ্গ-র সাধারণ সম্পাদক)

গণশক্তি, ১লা জানুয়ারি, ২০১৮


No comments:

Post a Comment