20191213

বিজেপি বদলে দিতে চাইছে প্রকৃত ভারত


মহম্মদ সেলিম

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) পেশ করেছে মোদী সরকার। বিলটি লোকসভায় পাশ হয়েছে। এই বিল আইনে পরিণত হলে বদলে যাবে প্রকৃত ভারত— আমাদের দেশ। আসলে লোকসভায় বিজেপি সংখ্যার জোরে পাশ করিয়েছে।

এই বিলের মাধ্যমে নাগরিকত্বকে ধর্মের ভিত্তিতে চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে। বিজেপি তাদের ২০১৪-র নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে বলেছিল শুধু হিন্দুদের কথা। পরে, কৌশলের অঙ্গ হিসাবে টোকেনের মত জুড়ে দেওয়া হয়েছে ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মকে। ভারত পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিল এক অনন্য উদাহরণ— ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। সেই ধারণাকেই  আঘাত করা হচ্ছে। আমরা কী করে অস্বীকার করব, শিখদের একাংশ দেশ ছাড়ছেন। খ্রিস্টানদের অনেকে চলে যাচ্ছেন গোলার্ধের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। হিন্দুদেরও অনেকে যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। স্থানান্তর, দেশান্তরের প্রধান কারণ আর্থিক। কখনও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক কারণও থাকে।

সেখানে এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রয়োজনীয়তা কী? দেশের ৯৯% যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষের  কোনও সুরাহা নেই এই বিলে। তাঁরা কাজ চান, খাবার চান, আশ্রয় চান, পরিশুদ্ধ জল চান, যথাযথ মজুরি চান, ফসলের দাম চান, সামাজিক সুরক্ষা চান, নিয়মিত ভাতা চান, কাজের নিশ্চয়তা চান। তারজন্য আন্দোলন, তারজন্য লঙ মার্চ, ৮ জানুয়ারি হবে দেশজোড়া ধর্মঘট।

এই মুহূর্তে দেশের সামনে এই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই মূল লক্ষ্য হওয়ার কথা। কিন্তু হতে দিচ্ছে না শাসকরা। যাদের প্রধান প্রতিভূ বিজেপি। মূল সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। প্রবল সঙ্কটের এই সময়েই নাগরিকতার মাপকাঠি ঠিক করার উদ্যোগ। এই ক্ষেত্রে শুধু ধর্মকেই ভিত্তি করা হচ্ছে না, ভাষা, জাতি এমনকি কোথাও কোথাও আঞ্চলিক সঙ্কীর্ণতাকেও ভিত্তি করে তোলা হচ্ছে। এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সেই সব বিচ্ছিন্নতা, বিভাজনকেই তীব্রতর করতে চাইছে। বিজেপি’র উদ্দেশ্যও তাই।

এর আগে বিজেপি প্রচার করত ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’ লোকসভায় মমতা ব্যানার্জিও আরএসএস, বিজেপি’র এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টায় মদত দিয়েছিলেন। অনুপ্রবেশের সূত্র ধরে বিজেপি প্রচার করত, একদিন নাকি আলাদা ‘বাঙালিস্তান’ তৈরি হয়ে যাবে। এখন তারা এনআরসি এনেছে। এনআরসি আসলে ‘নিউ রিফিউজি ক্রাইসিস।’ তা কিন্তু শুধু ভারত ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহ বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থার উল্লেখ করে সংসদে যা বলেছেন, তাতে দু’ দেশের সম্পর্ক ক্ষুন্ন হতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈদেশিক বিষয়ে, অন্য দেশের বিষয়ে সংসদে এই কথা বলার কথা নয়। যদি আদৌ তেমন বাস্তবতা থাকে, তাহলে রীতি মাফিক বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে কতবার এই নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন? কোনও উত্তর নেই।

এই বিলের নির্যাস হলো, বিজেপি-আরএসএস জনসংখ্যা আদান প্রদান করতে চাইছে। বার্তা দিতে চাইছে— প্রতিবেশী দেশগুলির হিন্দুরা আসুন। আধুনিক পৃথিবীতে এই ভাবে নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের আদান প্রদান আদৌ সম্ভব কিনা, তা এক বিরাট প্রশ্ন। তাছাড়াও এই বার্তা সেই সব দেশের এবং আমাদের দেশের স্থায়িত্ব, রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশকেও বিঘ্নিত করবে। উৎসাহিত হবে কারা? প্রতিবেশী দেশগুলির মৌলবাদী শক্তিগুলি উদ্দীপ্ত হবে। তাদের দেশের সংখ্যালঘু গরিব পরিবারগুলিকে ভয় দেখিয়ে বলার সুযোগ পাবে— ‘যাও, তোমাদের জন্য তো আলাদা দেশ হয়েছে।’ আসলে এই বিভাজনের বরাবর যে লক্ষ্য থাকে,  ধর্মীয়সহ নানা ধরনের মৌলবাদীদের সেই কায়েমী স্বার্থই জেগে উঠবে— সম্পত্তি দখল, জমি দখল। আমাদের দেশে তো বটেই আশেপাশের রাষ্ট্রগুলিতেও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে প্ররোচিত করে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে এই নাগরিকত্ব বিল।

ভারত দীর্ঘ সময় শান্তি, জোট নিরপেক্ষতা এবং বিভিন্ন দেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই, বিশেষত নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগ শুরুর পর থেকে দেশ তার সেই পথ থেকে একটু একটু করে সরেছে।

এই বিলের পিছনে রয়েছে বিজেপি’র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। সঙ্ঘ পরিবারের বহুদিন লালিত  হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি।

লোকসভায় বিল পেশের সময় অমিত শাহ দেশভাগের প্রসঙ্গ তুলেছেন। তাঁর ইতিহাস জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমার কাজ নয়। কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই দেশের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে চাইছেন তাঁরা। বিকৃত ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি দেশে সঙ্ঘের ভাবনার অন্যতম ধারক ছিলেন। তিনি দেশভাগের শুধু সমর্থকই ছিলেন না, দেশভাগ নিশ্চিত করতে তিনি সক্রিয় ছিলেন। দেশে ‘হিন্দুত্বের’ ভাবনার উদ্গাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার দেশভাগের পক্ষে ছিলেন। সামগ্রিকভাবে আরএসএস, হিন্দু মহাসভার মত সংগঠনগুলি মুসলিম লিগের মতই দেশভাগের পক্ষে কাজ করেছে, ব্রিটিশের মদতে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়েছিল। দাঙ্গা-হাঙ্গামায় প্ররোচনা দিয়েছিল। দেশকে ভাগের চক্রান্তে এরাই তিন পান্ডা। লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিক তাই বলেছেন, যা আরএসএস, তার স্বয়ংসেবকদের মাথায় ঢোকে।

কোন সময়ে দেশভাগের ব্লু প্রিন্ট? যখন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়েছেন, দেশে বিপ্লবী শক্তি উদ্দীপিত হয়েছে। বড় বড় ধর্মঘট হচ্ছে চটকলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। নৌবিদ্রোহ কাঁপিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাসকে। শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে সেই বিদ্রোহ। তার পক্ষে জেগে উঠছে সমাজের অন্যান্য অংশ। একই সময়ে তেভাগার দাবিতে কৃষক সংগ্রাম দুর্বার।

দেশ বিভক্ত হয়েছিল। কিন্তু মনে রাখতেই হবে, তবু এই দেশ ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ মেনে নেয়নি। পাকিস্তান যারা চেয়েছিল, তাঁরা মেনেছিলেন। ভারতে তা একটি ঘৃণ্য ধারণা। ভারতের সংবিধানে এই দেশ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক। বিজেপি সেই ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’-কে পুনরায় প্রয়োগ করতে চাইছে। তারা মানত জিন্না-মুসলিম লিগের সেই ধারণা। বিজেপি সেটাই নতুন করে চাপিয়ে দিতে চাইছে ভারতের উপর।

এটাই সঙ্ঘ পরিবারের লক্ষ্য। তারা  গণতন্ত্রকে মানে না। এরা গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে  পরিণত করতে চাইছে এথনিক (জাতিগত) গণতন্ত্রে। তা আমাদের সংবিধানের মূল ভাবনার বিরোধী। পৃথিবীতে জাতিগত গণতন্ত্রের উদাহরণ ইজরায়েল। যা আসলে গণতন্ত্রই নয়। ইজরায়েলের জায়নবাদী রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক। আরএসএস’র প্রধানরা বরাবর ইজরায়েলের এই ভাবনার প্রশংসা করেছে। কী সেই ভাবনা? একটি জাতিগোষ্ঠীর দেশ হবে। জায়নবাদী শাসকরা বলে ইজরায়েল সব ইহুদিদের দেশ। তেমনই এখানে বলার চেষ্টা হচ্ছে যে, যে কোনও হিন্দুর রাষ্ট্র ভারত। অর্থাৎ সংখ্যাগুরুর কর্তৃত্ব। কিন্তু ভারতে সেই মডেল চলতে পারে না। ভারত আর  ইজরায়েল এক নয়। ভারত নানা ধর্ম, জাতি, ভাষাভাষীর মানুষের মিলন ভূমি।

কিন্তু এখন একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে মহিমান্বিত করার অপপ্রয়াস চলছে। একই সঙ্গে এই ধারণা গড়ে তোলে একটি আশঙ্কা— ‘পবিত্রতা’ নষ্টের আশঙ্কা। যা অন্য ধর্ম, ভাষা, জাতির মানুষের প্রতি এক তীব্র ঘৃণার জন্ম দেয়। এই জেনোফোবিয়া গড়ে তোলারই চেষ্টা করেছে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার। কোনও অপরাধ ঘটলেই বলার চেষ্টা হয়েছে নির্দিষ্ট কোনও অংশের মানুষ এটা করেছে। কখনও তাদের বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশি’। কখনও বলা হয়েছে রোহিঙ্গা। কখনও পুরোপুরি একটি ধর্মের মানুষকে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। একদিকে দেখানো হচ্ছে হিন্দুদের ‘রাইট টু রিটার্ন’। অন্যদিকে নির্দিষ্ট একাংশকে ভয় দেখানো— ‘চলে যাও। পাঠিয়ে দেবো বাংলাদেশে, পাকিস্তানে।’ অন্য ধর্ম, জাতি, ভাষার মানুষকে চিহ্নিত করা হয় ‘এজেন্ট অব বায়োলজিক্যাল ডাইল্যুশন’ হিসাবে। পবিত্রতা নষ্ট করে দিচ্ছে, এমন একটা আশঙ্কা বিজেপি ছড়িয়ে দিতে চাইছে  হিটলারের জার্মানি আর ইজরায়েলের জায়নবাদী কৌশলে। এর পথ ধরেই ‘লাভ জিহাদ’, ‘ঘর ওয়াপসি’,‘ইন্টার-কাস্ট ম্যারেজ’-র বিরোধিতা এসেছে।

ভারতের ক্ষেত্রে হিন্দু আর্যদের আদিবাসী ধরে নিয়েই এই দেশকে ‘হিন্দুদের ভূমি’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে সঙ্ঘ পরিবার। কিন্তু কে প্রকৃত আদিবাসী? এর জবাব কে দেবে? আর্যরা কারা? আর্যরা কী আদিবাসী? ইতিহাস বলছে আর্যরা বহিরাগত। আদিবাসীরাই এই দেশের আদি বাসিন্দা। তারা বহিরাগত নন। বিজেপি তা মানে না। ঐতিহাসিক, নৃতাত্বিক সেই সত্যের প্রতিষ্ঠা আটকানোর জন্যই এদের তারা বনবাসী বলে। আদিবাসী বলে না। এদের আদিবাসী বললে প্রমাণ হয়ে যায় যে, তথাকথিত ‘আর্যরা’ বাইরে থেকে এসেছে। এই হচ্ছে চালাকি। এনআরসি’তে তাই আদিবাসীরাও আশঙ্কিত। কারণ, তাদের আর নথি কোথায়?

লক্ষ্য হলো আধিপত্য কায়েমের পরিকাঠামোগত বিন্যাস। অর্থাৎ এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে থাকবে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য এবং বাকিদের দ্বিতীয় শ্রেণি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা।

নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগের প্রথম পর্যায়ে তার ঘোর সমর্থক তাত্ত্বিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এটি পরিকাঠামোগত সমন্বয়ের ব্যবস্থা। বেসরকারিকরণ, বিলগ্নি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে দুর্বল করার সেই তত্ত্বের প্রভাব আজ আমরা বুঝতে পারছি। ছাঁটাই, বেকারি, কৃষি সঙ্কট, অভাব, মন্দার এই প্রভাবের কথা বামপন্থীরা বলেছিল ৯০-র দশকেই। নয়া আর্থিক নীতি, উদারনীতির পথকে তখন প্রতিক্রিয়ার শক্তি প্রবলভাবে প্রলোভনের বিষয়বস্তু করে তুলে ধরেছিল। আজ তার প্রকৃত রূপ বেরিয়ে পড়েছে। কিছু লোক প্রচুর ধনী হয়েছে। কিন্তু সিংহভাগ মানুষের অবস্থা খারাপ হয়েছে। আরও খারাপ হচ্ছে।

এবার বিজেপি চাইছে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পরিকাঠামোগত বদল আনতেএই নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের লক্ষ্য হলো নাগরিকত্বে বিভাজন। গ্রেডেশন করা। একদল হবে প্রেফারেবল— তারাই প্রধান, গ্রহণযোগ্য। আর এক দল হবে ব্রাত্য। মানসিক গোলামি হবে তাদের বৈশিষ্ট্য। সংখ্যাগুরুদের মধ্যে ধাপে ধাপে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হবে ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু, ব্রাত্যদের সম্পর্কে। খাওয়া, পোশাক সমস্ত প্রশ্নে তৈরি করা হবে ভীতি, তার থেকে বেশি ঘৃণা। এখনও তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখি— কোনও পাড়ায়, কোনও আবাসনে ঘর পাওয়ার ক্ষেত্রে। এবার এটাই ছড়িয়ে দেওয়া হবে সারা দেশে। এটা শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে থেমে থাকবে না। এই ধরনের বিভাজন জাতি, সংস্কৃতি, ভাষার ভিত্তিতেও ছড়িয়ে পড়বে।

উত্তর-পূর্বে এর অন্যরকম প্রভাব পড়বে। এর প্রভাব পড়বে বাজারে।  বিল পেশ করতে গিয়ে অমিত শাহ বলেছেন  ইনার লাইন পারমিট ব্যবস্থা থাকবে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানুষ তার বিরোধিতা করেছেন। কারণ, এতে সেখানকার পর্যটন, ব্যবসা মার খাবে। যারা কাশ্মীরের ক্ষেত্রে বললেন, ৩৭০ নং ধারা তুলে দিলে নাকি কাশ্মীরের উন্নতি হবে, বিনিয়োগ বাড়বে। জমি কিনতে পারবে। কাশ্মীরের উন্নতি হবে। তারাই উত্তর পূর্বাঞ্চলে বলছেন ইনার লাইন পারমিট চালু হবে! নাগরিকরা যেতে পারবে না। তাহলে এখানে  ‘ওয়ান নেশান-ওয়ান অ্যাক্ট’ কোথায় গেল? নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে শুধু ধর্ম, জাতি, ভাষাতেই বিভাজন ঘটানো হয়নি। দেশকে আঞ্চলিকতাতেও বিভক্ত করা হয়েছে। কে কোথায় কাঙ্ক্ষিত, কে কোথায় ব্রাত্য তার সীমানা তৈরি হচ্ছে। একাংশের আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এই জাতিগত বা ‘এথনিক ডেমোক্র্যাসি’ হলো নন সিভিক ফর্ম অব ডেমোক্র্যাটিক স্টেট। অর্থাৎ সামাজিক স্বাধীনতা থাকবে না। মানবাধিকার থাকবে না।

প্রথমে আতঙ্ক ছড়ানো হলো। প্রতিবেশী দেশে অস্থিরতা ছড়ালো। যে যুদ্ধ সীমান্তে ছিল, তাকে নিয়ে এল দেশের মধ্যে। প্রতিটি গ্রাম-শহর এখন যুদ্ধক্ষেত্র। অথচ সরকার গঠনের সময়ে এই বিজেপি কী বলেছিল? এরা বলেছিল, যুদ্ধ করেই পাকিস্তানকে শায়েস্তা করবে। এখন সেই যুদ্ধটা তারা নিয়ে আসছে দেশের মধ্যে। প্রতিদিন ঘৃণা, আশঙ্কা, বিভাজন নিয়ে একটি দেশের মানুষ এগবে কী করে?

আতঙ্ক, দাঙ্গা-হাঙ্গামা অনেককে দেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য করে। সেই পরিবেশ ওরা ফিরিয়ে আনতে চাইছে। দেশভাগের সময়ে পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে যে উদ্বাস্তু পরিবারগুলি ভারতে এসেছিলেন, তাদের সেই ক্ষতকে জাগিয়ে তুলতে চাইছে সঙ্ঘ পরিবার। অন্যদিকে নিউ রিফিউজি ক্রাইসিস তৈরি করতে চাইছে। নতুন আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চাইছে। বাস্তবে পারবে কিনা, ঠিক নেই। আপাতত তা ভার্চুয়াল করে তুলতে চাইছে। যা ডেকে আনবে এক দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা।

সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই আমাদের দেশের গড়ে ওঠার ভিত্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামও বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্যের আদর্শকে তুলে ধরেছে। ভগৎ সিং, সূর্য সেন, আসফাকউল্লাহ, রামপ্রসাদ বিসমিল, ক্ষুদিরাম বসুদের লড়াই ছিল আপসহীন।

এরাজ্যে এক জটিল পরিস্থিতি। তৃণমূল আর বিজেপি’র নকল কুস্তি আর আসল দোস্তি।  তৃণমূল কংগ্রেস কী করেছে? তারা মুখে বিরোধিতার কথা বলেছে। এনআরসি, এনপিআর, সিএবি হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচির অংশ। তাদের বিভাজনের রাজনীতির মোকাবিলা করতে হলে দরকার আদর্শভিত্তিক লড়াই। মমতা ব্যানার্জির রাজনীতির কোনও আদর্শ নেই। তিনি শুধু আদর্শহীনতায় ভুগেছেন তাই নয়, সুবিধাবাদেও নিমজ্জিত হয়েছেন। মমতা ব্যানার্জি ধর্মীয় বিভাজনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছেন সমাজে। এখনও তিনি জনগণনা এবং জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)-কে গুলিয়ে দিচ্ছেন। রাজ্যে ডিটেনশান ক্যাম্পের জন্য জমি চেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। মমতা ব্যানার্জির সরকার সেই জমি দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশের মত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার বিরোধিতায় নিজের দলের পুরো শক্তিকে হাজির করেননি তিনি। এই হলো বিজেপি, সঙ্ঘের সঙ্গে আপসকামিতার পরিণাম। মমতা ব্যানার্জি আসলে সঙ্ঘের রাজনীতির পরিপূরক হয়ে উঠেছেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি গত আট বছরে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্ট করেছেন। মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসকে ছোবল মারতে চেয়েছে তৃণমূলই।

দ্বিচারিতা, আপস করে বাংলাকে রক্ষা করা যাবে না। দেশ আরো বিপন্ন হবে। আপসহীন সংগ্রামই পথ। একমাত্র বামপন্থীরাই পারে বিভিন্ন মঞ্চ, সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করে রাজ্যকে, দেশকে রক্ষা করতে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়েই পড়া এখন একমাত্র পথ। 

গণশক্তি, ১২ডিসেম্বর, ২০১৯ 

No comments:

Post a Comment