20191213

অনৈক্যের বাতাবরণ তৈরিই আসল উদ্দেশ্য


দেবেশ দাস

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৯ লোকসভায় পাশ হয়েছে। বিলের মূল কথা— ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবধি আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আগত ৬টি ধর্মাবলম্বী (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান) মানুষ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হবেন না। বাইরের দেশের কোনও নাগরিকের ভারতে ঢুকতে পাসপোর্ট লাগে, ভিসা লাগে। পাসপোর্ট-ভিসা যদি না থাকে বা থাকলেও তার সময়সীমা পেরিয়ে যায়, তবে সে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। বিলের মানে দাঁড়াচ্ছে ঐ ৬টি ধর্মের কেউ ঐ তিনটি দেশ থেকে এইভাবে ভারতে ঢুকলে তাকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী ধরা হবে না। সে কিন্তু নাগরিক হচ্ছে না, তার ভোটাধিকার থাকছে না, এমনকি সে উদ্বাস্তুও হচ্ছে না, এখন সে শুধু বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নয়। বিলে আছে, এই সমস্ত লোকদের সরকার নাগরিকত্ব দিতে পারে। এদেশে মোট পাঁচ বছর বাস করলে সে ভারতের নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবে।

তার মানে কি ঐ ৩টি দেশের উপরে-উল্লেখিত ৬টি ধর্মের সমস্ত লোক এদেশে এলে এইভাবে পাবে? ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে যে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি হয়, তার রিপোর্ট ২০১৯-এর জানুয়ারিতে বেরিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে প্রশ্নোত্তরের সময় স্বরাষ্ট্র দফতর বলেছে যে এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র দফতরের ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ও ১৮ জুলাই, ২০১৬ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কাজ হবে। এই বিজ্ঞপ্তিতে, কেউ যদি ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বা সেই ধরনের নিপীড়নের ভয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে কোনও বৈধ কাগজপত্র ছাড়া আসে তাদের কথা বলা হয়েছে।  লোকসভায় সদ্য পেশ হওয়া বিলের পরিপ্রেক্ষিতে কী বিধি তৈরি হয়, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

স্বরাষ্ট্র দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে যদি শুধু ধর্মীয় নিপীড়নের কথাই বলা হতো, তাতেই তো যথেষ্ট ছিল। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে তো মুসলমানদের উপর ধর্মীয় নিপীড়ন হচ্ছে না, তারা এমনিতেই বাদ পড়ত। কিন্তু, অনেকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতো করে শুধু মুসলিম বাদ দিয়ে অন্য ধর্মগুলির নাম করা হয়েছে। এর আসল উদ্দেশ্য– লিখিত পড়িত ভাবে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করা ও তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার গড়ে তোলা। এক অনৈক্যের পরিবেশ গড়ে তোলাই উদ্দেশ্য।

নাগরিক সংশোধনী বিলে ধর্মীয় নিপীড়নের কথা না বলেই মুসলিমদের বাদ রাখা হয়েছে। সংবিধান সম্মত এই কাজ? সংবিধানের ১৪নং ধারা বলছে আইনগত সমতা বা আইনগত সুরক্ষা থেকে কোনও ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যায় না। সেক্ষেত্রে আইনের মাধ্যমে কোনও একটা বিশেষ সুবিধা কোনও একটা ধর্মাবলম্বী মানুষদের বাদ দিয়ে ঘোষণা করলে তা সংবিধানের ১৪নং ধারাকে অমান্য করা হয়। স্বরাষ্ট্র দফতরের বিজ্ঞপ্তি ও এই নাগরিক সংশোধনী বিল সেটাই করছে। বিজেপি ভারতের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ তকমা মুছে ফেলতে চায়।  

এই বিল অনুযায়ী, স্বাধীনতার পরে যারা বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে তাড়া খেযে এসেছেন তারা সবাই কি এবার ভারতের নাগরিক হয়ে যাবেন? হবেন না। ঐ জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির সভাতে প্রশ্নোত্তরের সময় ইনটেলিজেন্স ব্যুরো বলেছিল– কয়েক দশক আগে যারা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে এদেশে এসেছিল বলে দাবি করছেন ও ভারতের নাগরিকত্ব চাইছেন, তাদের বেশিরভাগই দেশভাগ হওয়ার পরপর যখন ব্যাপক হারে দেশান্তর হচ্ছিল তখন এসেছে, এদের দাবি আজ মানা সম্ভব নয়। ইনটেলিজেন্স ব্যুরো আরো জানিয়েছে, যে এতদিন পর্যন্ত যতো হিন্দু ঐ তিনটি দেশ থেকে এসেছে, নাগরিকত্ব বিল অনুযায়ী, তার মধ্যে মাত্র ২৫৪৪৭ জন হিন্দু নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী (এদের অনেকে পাঞ্জাবের), এদের আবার পাসপোর্ট-ভিসা আছে, ভিসার মেয়াদটা ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাহলে কয়েক লক্ষ বাঙালি হিন্দু যে আসামে এনআরসি’তে বাদ পড়ল, তাঁদের ভাগ্যে আর শিকে ছিড়ছে না। তবে, এবারের বিল পেশের সময়ে বলা হয়েছে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যাবে। নথিভুক্তি বা দেশীয়করণের মাধ্যমে সেই আবেদন বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন, সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

কিন্তু সম্প্রতি কেউ যদি ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য ওদেশ থেকে এসে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে কি হবে? জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির রিপোর্টে স্বরাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, সম্প্রতি যারা এসেছে, তাদের কাগজপত্র দেখা যেতে পারে, সেই কাগজপত্র দিয়ে যদি প্রমাণ হয় যে তারা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার, তবে তার দাবি বিবেচনায় আসবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মীয় নিপীড়ন যদি কারোর উপর হয়ে থাকে বা তার ভয়ে যদি কেউ এদেশে এসে থাকে সে কিভাবে এটা প্রমাণ করবে যে, এটা তার উপরে হয়েছে? সে কি তাহলে পুলিশে ডায়েরি করে প্রমাণ নিয়ে আসবে? তাড়া খেযে যে আসছে, কী করে সে প্রমাণপত্রগুলি গুছিয়ে নিয়ে আসবে? জানবেই বা কী করে যে কী কী প্রমাণ নিয়ে যাওয়া দরকার। এদেশে এসেই বা জানবে কি করে যে কোথায় তাকে রিপোর্ট করতে হবে?

কোনও দেশে যদি কারো উপর ধর্মীয় নিপীড়ন হয়, নিপীড়িত মানুষজনের প্রতি সহানুভুতি, তাদের পাশে থাকা ভালো কাজ। কিন্তু, শুধু ধর্মীয় নিপীড়ন কেন? যে কোনও নিপীড়নের বিরুদ্ধেই তো থাকতে হবে। আমরা ছিলামও। পূর্ব-পাকিস্তানের উপর যখন পশ্চিম পাকিস্তান ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ভারত যোগ দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে, দেশের মানুষ তা সমর্থন করেছিল। লাখো লাখো উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। এই নিপীড়ন তো ধর্মীয় নিপীড়ন ছিল না। আজ বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে মুসলিম মৌলবাদী বা দাঙ্গার বিরুদ্ধে কথা বলে যদি কোনও মুসলিম নিপীড়নের মুখে পড়ে, সে মুসলিম বলে কোনো হিন্দু তাকে সমর্থন করবে না? কোনো কোনো মুসলিম বুদ্ধিজীবীকে খুন করা হয়েছে মৌলবাদের বিরুদ্ধে বলার জন্য। বাংলাভাষা বাঁচাতে যদি কোনো মুসলমানের উপর নিপীড়ন হয়, বাংলাভাষী হিন্দুরা মুখ ঘুরিয়ে থাকবে? বহু মুসলিম তো পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষা বাঁচাতে শহীদ হয়েছে। 

আর শুধু ঐ ৩টি দেশই বা কেন? শ্রীলঙ্কা থেকে যে ১ লক্ষ শরণার্থী এসেছে তাদের কি হবে? বার্মা যে হাজার হাজার বাংলাভাষীকে তাড়ানো হলো তার কিছু হবে কি? প্রতিবেশী সব দেশের কথা ভাবা হোক। প্রতিবেশী সব দেশেই কারো উপর নিপীড়ন হলে আমরা তার পাশে দাঁড়ানোই তো ভালো। ১৯৪৮ সালে প্যারিসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলির সভায় মানবাধিকার সম্বন্ধে একটি সার্বজনীন ঘোষণায় বলা হয়েছে কোনো নিপীড়নের থেকে রক্ষা পেতে প্রত্যেকেরই অন্য দেশে আশ্রয় চাওয়া ও পাওয়ার অধিকার আছে। প্রতিবেশী সমস্ত দেশগুলির থেকে এই  আবেদন আসলে তা গ্রহণ করতে অসুবিধা নেই। শুধু মুসলিমদের বাদ দিয়ে একটা আইন চালু করে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে ভারতের যে সম্মান ছিল তার মুখ পোড়ানো কেন? মানুষে মানুষে গোলমাল লাগানোই আসল উদ্দেশ্য।

গণশক্তি, ১১ডিসেম্বর, ২০১৯



No comments:

Post a Comment