20200720

সমমর্যাদা, স্বাধীন অবস্থান নিয়ে চীনের সঙ্গে কথা বলুক ভারত



পিপলস ডেমোক্র্যাসি পত্রিকায় সম্পাদকীয়
---------------------------------------

      
নয়াদিল্লি, ২৭ জুন— সমমর্যাদা ও স্বাধীন অবস্থান নিয়ে চীনের সঙ্গে কথা বলার দৃঢ়তা থাকতে হবে ভারতের। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাস্তবতা বুঝতে হবে, দেশের মূল স্বার্থ ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। মার্কিন রণনীতির অংশ হওয়া ভারতের স্বার্থরক্ষায় অনূকূল নয়। ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ সম্পর্কে এই অবস্থান জানিয়েছে সিপিআই(এম)। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র ‘পিপলস ডেমোক্র্যাসি’র সম্পাদকীয়তে এই অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, গালওয়ান নদীর উপত্যকায় সীমান্ত সংঘাতে ২০ জন ভারতীয় জওয়ানের প্রাণহানি স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসীর মনে ক্রোধের সঞ্চার করেছে। এই ঘটনা মর্মান্তিক, নিন্দাযোগ্য। বিশেষ করে ৬ জুন উভয় পক্ষের পদস্থ সামরিক অফিসারদের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনা হ্রাস ও সেনা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মতৈক্য হওয়ার পরেও এই ঘটনা ঘটেছে। ১৫ জুন রাতে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে কোন পরিস্থিতিতে শারীরিক সংঘাত ঘটল তার অনেক কিছুই আজও অজানা। সরকার সে বিষয়ে স্পষ্টতা দিতে কোনও উদ্যোগই নেয়নি।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ১৯ জুন সর্বদলীয় বৈঠকে সব রাজনৈতিক দলই বলেছে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেশ ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে লাদাখের চলতি সমস্যা এবং আমাদের অবস্থান কী ছিল তা নিয়ে কোনও প্রশ্নই করা যাবে না। যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, শিক্ষা নিতে হবে। তাহলেই সরকার এবং দেশ সামনের দিনে এগতে পারবে।

পিপলস ডেমোক্র্যাসি বলেছে, ১৭ জুন ভারত ও চীনের বিদেশ মন্ত্রীদের মধ্যে টেলিফোনে কথা হয়। নিজেদের অবস্থানের কথা দু’দেশই বলে। কিন্তু তারপরেও তাঁরা এই মতৈক্যে পৌঁছায় যে, দায়িত্বশীলভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করা হবে, উভয় পক্ষই ৬ জুনের সেনা সরানোর সমঝোতাকে আন্তরিক ভাবে রূপায়ণ করবে। তাছাড়াও, ‘উভয় পক্ষই এমন কিছু করবে না যাতে উত্তেজনা বাড়ে, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও প্রোটোকল মেনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।’ সর্বদলীয় বৈঠকে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সিপিআই(এম) সমর্থন করেছে।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিশোধ ও সামরিক প্রত্যাঘাতের জিগিরমুখী আওয়াজকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যে রাজনৈতিক মনোভাবেরই হোন না কেন, কোনও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই এই রকমের অবাস্তব ও অপরিণত অবস্থানের শরিক হতে পারেন না।

আরও কেউ কেউ বলছেন চীনের সঙ্গে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার সমস্ত চুক্তি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সীমান্ত প্রশ্নে একাধিক চুক্তি হয়েছে। ১৯৯৩সালে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চুক্তি হয়। এরপরে ১৯৯৬, ২০০৫, ২০১৩, ২০১৫-তে আরও চুক্তি হয়েছে। কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় সরকারের আমলেই এই চুক্তিগুলি হয়েছে। এইসব চুক্তি এবং তার অধীনে মতপার্থক্য ও সংঘাত মোকাবিলার যে ব্যবস্থার কথা স্বীকৃত হয়েছিল তার ফলেই হিমালয়ের উচ্চতায় শান্তি বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। ৪৫ বছর আগে ১৯৭৫ সালে শেষ সশস্ত্র সংঘাতে প্রাণহানি ঘটেছিল। এই সমস্ত প্রয়াসকে একবারে নস্যাৎ করে দেওয়া ভুল হবে। বরং, দরকার হলো অতীতের এই চুক্তিগুলির ওপরে আরও শক্তপোক্ত চুক্তির দিকে যাওয়া।

এখন সামনে এগতে হলে আশু করণীয় কাজ উত্তেজনা প্রশমন। তা করতে গেলে উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করতে হবে। কিন্তু তার জন্য স্পষ্ট দীর্ঘমেয়াদী স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিভঙ্গি চাই।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, লাদাখের সমস্যাকে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন ‘সালামি স্লাইস’ বা অল্প অল্প কেটে নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতিতে ভারতীয় ভূখণ্ড নিয়ে নিতে চাইছে চীন। কিন্তু কেবল কিছু এলাকা দখলের চেষ্টা হিসাবে এই ঘটনাকে দেখা ঠিক হবে না। সীমান্তে এই গোলমালের পিছনে গভীরতর কারণ রয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সাধারণ সংঘাতের বাইরেও ভূ-রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। আরও মৌলিক ব্যাপার হলো, ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কিছু মাত্রায় অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে

পিপলস ডেমোক্র্যাসি বলেছে, চীনের তরফে মর্মান্তিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, ভারত সরকারের অবস্থানও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে দেওয়া এবং জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখকে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত করার প্রতিক্রিয়া পড়েছে দেশের বাইরেও। চীন তাদের অবস্থান থেকে এই ঘটনাকে দেখেছে। চীন দু’বার ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বলেছে চীনের দাবি রয়েছে এমন এলাকায় প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন হিসাবেই এই পদক্ষেপকে তারা দেখছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক বেসরকারি বৈঠকে চীন এই প্রসঙ্গ তোলার পরেও ভারত সরকার এড়িয়ে গেছে।

এই পদক্ষেপ নিয়ে সরকারের শীর্ষ পদাধিকারীদের রাজনৈতিক চমক দেখানোর চেষ্টাও প্রভাব ফেলেছে। ৬ আগস্ট জম্মু কাশ্মীর পুনর্গঠন নিয়ে সংসদে আলোচনার সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেন, ‘‘আমি নথিভুক্ত করে রাখতে চাই যখনই আমি সংসদে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য বলব তার মধ্যে পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং আকসাই চিন অন্তর্ভুক্ত।’’ গত সেপ্টেম্বরে বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ‘একদিন পাক অধিকৃত কাশ্মীর বাস্তবেই দখলে আসবে’ বলে মন্তব্য করেন।

সিপিআই(এম)’র মুখপত্র বলেছে, মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফার প্রথম বছরে ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। এই রণনীতির লক্ষ্য চীনকে প্রতিহত করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার চতুর্দেশীয় আঁতাতকে গত সেপ্টেম্বরে মন্ত্রীপর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। নিউইয়র্কে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময়ে চার দেশের বিদেশ মন্ত্রীরা বৈঠকে বসেছিলেন।

চলতি মহামারীর সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনে চীনকে কোণঠাসা করার জন্য মার্কিন উদ্যোগের সঙ্গেই ভারত সুর মিলিয়েছে। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মার্কিন অভিযোগের প্রতিধ্বনি করে দাবি করেছেন চীনের গবেষণাগারে করোনা ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে।
এসবই লাদাখে সমস্যাকে বাড়িয়েছে বলে মনে হয়। দৌলতবাগ ওল্ডি পর্যন্ত সড়ক ও তার উত্তরমুখী শাখা সড়ক নির্মাণ ভারত বৈধভাবেই করেছে সীমান্ত পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য। কিন্তু চীন এখন তা পৃথক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, সরকারকে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন আমাদের প্রতিবেশিদের সঙ্গে সমস্যা বাড়ছে। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে জটিল সীমান্ত সমস্যা তো রয়েইছে, নেপালও এখন কালাপানি এলাকা নিয়ে বিতর্ক তুলেছে। আরেক বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশি বাংলাদেশ ক্রমাগত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে বাগাড়ম্বর এবং সিএএ-এনআরসি পরিকল্পনায় এইসব ‘ঘুনপোকাকে’ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনায় অস্বস্তির বৃত্তে পড়ে গিয়েছে। এসবই চীনের নকশার ফলে হচ্ছে, একথা ধরে নেওয়া নিজেকেই মোহাবিষ্ট করার শামিল। বাস্তব হলো, বিজেপি-আরএসএস’র অতি জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্বের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে।

সিপিআই (এম)’র মুখপত্রে বলা হয়েছে, চীনের সঙ্গে চলতি সংঘাতের সমাধান ছাড়াও বকেয়া সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে ভারতকে। উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক হস্তক্ষেপেই তা সম্ভব। চীন সম্পর্কে আমাদের স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনা করা দরকার। প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এমকে নারায়ণন একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে সম্প্রতি সওয়াল করেছেন ভারতের স্বার্থ সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষা করতে হলে চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে ভারতের জোটনিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া উচিত। পশ্চিমী শক্তিগুলির অনুরাগী স্ট্র্যাটেজিক বিশেষজ্ঞ ও দালালদের ক্রমবর্ধমান দাবির তুলনায় নারায়ণনের পরামর্শ অনেক বিবেচনাপ্রসূত। মোদী সরকার মার্কিনীদের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কও বাড়িয়ে চলেছে। সরকারের ভেবে দেখা উচিত চীনের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে আমাদের স্বার্থ রক্ষা হবে কিনা।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, সমমর্যাদা ও স্বাধীন অবস্থান নিয়ে চীনের সঙ্গে কথা বলার দৃঢ়তা থাকতে হবে ভারতের। আমাদের মূল স্বার্থ পরিত্যাগ করার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। দরকার এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যারা বাস্তবতা উপলব্ধি করে এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ ও স্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করতে সক্ষম।

গণশক্তি, ২৮ জুন, ২০২০

No comments:

Post a Comment