জ্যোতি বসু প্রায়শই
তাঁর সম্পর্কে বলতেন, উনি হচ্ছেন ‘গড’স্ ওন ম্যান’। ইংরাজী পরিভাষায় যার
অর্থ হচ্ছে, সমস্ত
দিক থেকে নিখুঁত একজন ব্যক্তি। পার্টি থেকে যখন সমর মুখার্জিকে যখন যে দায়িত্ব
দেওয়া হয়েছে, তিনি
তা এতটাই নিখুঁত ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করতেন যে তা সকলের কাছে শিক্ষণীয় ছিল।
১৯৭১ সালে সমর মুখার্জি
লোকসভায় পার্টির সহকারী দলনেতা থাকার সময় তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন
প্রকাশ কারাত। তিনিই সমর মুখার্জি সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জ্যোতি বসুর এই
মন্তব্যের কথা বলেছিলেন তাঁর শততম জন্মদিন উদযাপনের দিন। পরে তিনি তা পিপলস্
ডেমোক্রেসি পত্রিকায় লিখেছিলেন (Comrade Jyoti Basu
used to say that Samarda is “God’s own man”.
This saying in English denotes a selfless person who has all the virtues
of a good human being.)।
আমতা পীতাম্বর
হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সমর মুখার্জিকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল স্কুল থেকে।
অপরাধ, গান্ধীজীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্র ধর্মঘট এবং গেটে পিকেটিং করা।
তাঁর নেতৃত্বেই আমতার ছাত্ররা মদের দোকানে পিকেটিং করে,
বিদেশী কাপড় পুড়িয়ে আইন অমান্য করেছিল। ব্রিটিশ
পুলিস সমর মুখার্জি এবং তাঁর তুতো ভাই বারীন মুখার্জির বিরুদ্ধে ১০৭ ধারায় মিথ্যা
মামলা দায়ের করে। তাঁদের এক বছর কারাদণ্ড হয়। তাঁদের প্রেসিডেন্সি জেলে আটক করা
হয়েছিল। এটাই ছিল সমর মুখার্জির প্রথম কারাবাস। মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে সমর
মুখার্জি এবং বারীন মুখার্জি আদালতে পালটা অভিযোগ করেন। ফলে ছয়দিন কারাবাসের পরই
তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। ১৯৩১ সালে গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর তাঁদের বিরুদ্ধে
অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
জেল থেকে মুক্ত হয়ে
তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যাবার ইচ্ছায় আবার স্কুলে ভর্তি হবার চেষ্টা করেন। কিন্তু খুব ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে
বহিষ্কৃত ছাত্রকে কোনো স্কুলই ভর্তি করার সাহস পায়নি। এই সময়ে ১৯৩২ সালে হাওড়ার
পানপুরে কৃষকদের এক সমাবেশে বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি,
সমর মুখার্জিকে বলেন,
‘তুমি তো আমতার ডি
ভ্যালেরা’। তিনিই
তখন লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখে বউবাজার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক গিরীন্দ্রনাথ
ব্যানার্জির কাছে তাঁকে পাঠান। গিরীনবাবু সমর মুখার্জিকে তাঁর স্কুলে দশম শ্রেণীতে
ভর্তি করে নেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সমর মুখার্জি সিটি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন
এবং ইউনিভার্সিটি ল’ কলেজে ভর্তি হন।
১৯৪০ সালে কমিউনিস্ট
পার্টির সদস্য হওয়ার পর থেকে ৭৩ বছর ধরে পার্টি অফিস বা পার্টি কমিউনেই জীবন
কাটিয়েছেন সমর মুখার্জি। একজন কংগ্রেসকর্মী থেকে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সাধারণ
সম্পাদক, কমিউিনস্ট পার্টির সদস্য থেকে কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সম্পাদক, পার্টির
রাজ্য কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পলিট ব্যুরো সদস্য, সিআইটিইউ-র সাধারণ সম্পাদক
ইত্যাদি জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন সমর মুখার্জি। বিধায়ক, সাংসদ
হয়েছেন, সংসদে দলের নেতাও ছিলেন দীর্ঘদিন। সাংসদ হিসেবে তাঁর মাসিক ভাতার
অধিকাংশটাই পার্টি তহবিলে জমা দেওয়ার পরেও যা অবশিষ্ট থাকতো, সেই টাকাও প্রতিবছর
কোনো এক সময়ে কখনো ৫০হাজার, কখনো ৬০হাজার টাকা পার্টি তহবিলে জমা দিয়ে দিতেন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সেই টাকা তিনি কখনো ব্যয়
করতেন না। রাজ্য দপ্তরেও এভাবে টাকা জমা দিতেন। এই অনুকরণীয় জীবনধারা ছিল শেষদিন
পর্যন্ত।
আবার ওপার বাংলা থেকে
আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের জন্য লড়াই করতে সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা
পরিষদ (ইউসিআরসি) তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। উদ্বাস্তুদের ন্যায়সঙ্গত দাবি
নিয়ে কখনো দিল্লি, কখনো কলকাতায় সরকারের কাছে গিয়ে হাজির হতেন তিনি। একজন পশ্চিমবঙ্গীয় হয়েও
পুর্ববঙ্গ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের স্বার্থে আজীবন তিনি যে লড়াই
করেছেন, তা এককথায় অসাধারণ!
শেষদিকে, কলকাতায় পার্টির
কেন্দ্রীয় কমিটি বা পলিট ব্যুরোর বৈঠক হলে শীর্ষ নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে
যেতেন দিলখুসা স্ট্রিটের কমিউনে। ২০১০ সালের ৯জানুয়ারি ভিএস অচ্যুতানন্দন দেখা
করতে গিয়েছিলেন কমিউনে। তারই একটি মুহূর্তের ছবি নিবন্ধে যুক্ত করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment