20160404

শিল্পের জায়গায় খেলার মাঠ, রুগ্‌ণতায় দৌড়োচ্ছে মমতা-শাসন

চন্দন দাস

·      খড়্গপুর থেকে চকচকা শিল্পতালুক সব বেহাল
·      চার বছরে রুগ্‌ণ হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি ছোট মাঝারি কারখানা
·      ক্ষুদ্রশিল্পে সহায়তা নেমেছে ৯হাজার থেকে ৩হাজারে
·      ক্ষুদ্রশিল্পে কর্মসংস্থান ৮৬ হাজার থেকে নেমে এসেছে ২৪ হাজারে


হওয়ার কথা ছিল শিল্প তালুক। সেখানে হবে খেলার মাঠ ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।

মুখ্যমন্ত্রী খেলাধুলা ভালোবাসেন বলে এমন ঘোষণা করেননি। তিনি শিল্প আনতে পারেননি বলে এমন ঘোষণা করেছেন। ‘‘কিন্তু খড়্গপুরের ওই বিদ্যাসাগর শিল্প তালুকে কাজ হবে বলে যে যুবকরা আশা করেছিলেন, রেলশহরের মাঠে তাঁরা কী ফুটবল, ক্রিকেট খেলে পেট ভরাতে পারবেন?’’ মেদিনীপুরের বাসিন্দা, রাজ্যের ছাত্র আন্দোলনের নেতা সৌগত পন্ডার এই প্রশ্ন জেলার অনেকেরই।

রাজ্যের শিল্প এবং শিল্পে কাজ নিয়ে কেমন ছেলেখেলা চলছে তারই যেন প্রমাণ এই ঘটনা। বেশিদিন আগের ঘটনাও নয়। গত ৬ই জানুয়ারি মেদিনীপুর থেকে খড়্গপুরের বিদ্যাসাগর শিল্প তালুকের এই রূপান্তরের ঘোষণা করেছেন মমতা ব্যানার্জি। যদিও, সেই স্টেডিয়াম আদৌ হলে তার নাম কী হবে? তা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী জানাননি।

২০০৬ থেকেই পশ্চিমবঙ্গ শিল্প উন্নয়ন নিগম ওই শিল্প তালুক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। পশ্চিমাঞ্চলসহ রাজ্যে বেশ কয়েকটি বড় শিল্পের সম্ভাবনা শিল্প তালুকগুলির ভিত্তি ছিল। জিহারপুর, চকগণেশ, জফলা, রুইসন্ডা, রূপনারায়ণপুর, বড়ডিহাসহ সংলগ্ন এলাকাগুলির কৃষকদের থেকে জমি নেওয়া হয়। প্রায় ১২০০ একর জমি পাওয়া যায় তালুক গড়ার। কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি সংস্থা জমি কেনে। কিন্তু নন্দীগ্রাম-শালবনীর নৈরাজ্যের প্রভাব এখানেও পড়ে। বাধা ছিল এলাকার তৃণমূল কংগ্রেসেরও। ফলে তালুকটি পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। এই ক্ষেত্রে স্বভাবসিদ্ধভাবে আর একটি ঘটনাও ঘটিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী। দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের সময়কালে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন খড়্গপুরের ওই জমিতে মেডিক্যাল কলেজ, লোকো পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি।

তাও হয়নি। এবার নতুন স্টেডিয়ামের ঘোষণা।

এমন উদাহরণ কোচবিহার থেকে নন্দীগ্রাম অনেকই আছে। কোথাও প্রতিশ্রুতি পালিত হয়নি। বরং রুগ্‌ণতার রেসে পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে চলেছে সবচেয়ে দ্রুত।

কোচবিহারে গত নভেম্বরের শেষে গিয়ে শিল্পতালুকে বিনিয়োগের জন্য কাকুতি মিনতি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শিল্পপতিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘‘দয়া করে দূরের জেলাগুলিতে কাজ করুন। আমি সহযোগিতা করবো।’’ কিন্তু পরিবেশ নেই। দেদার তোলা আদায়। পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে। ফলে প্রায় পনেরো বছরের পুরনো চকচকা শিল্প তালুকে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়েছে গত সাড়ে চার বছরে। নতুনের দেখা নেই। তাই কাজও নেই। ২০১১-তে ৬৫টি কারখানা ছিল চকচকায়। এখন খাতায় কলমে ৪৫টি আছে। তার ১৫টিতে উৎপাদন হয় না।

উত্তর কিংবা দক্ষিণ পশ্চিম সর্বত্র একই হাল। রুগ্‌ণতায় দৌড়োচ্ছে রাজ্য।

বড় শিল্পে জোর ধাক্কা খেয়ে মমতা ব্যানার্জি ইদানিং বারবার ছোট, মাঝারি শিল্পের গুরুত্বের কথা বলেন। কিন্তু সেখানেও রীতিমত ল্যাজেগোবরে অবস্থা। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির শাসনের চার বছরে ৩০ হাজারের বেশি ছোট, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প রুগ্‌ণ হয়েছে। ২০১৫-র মার্চের শেষে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮হাজার ৮৩৫টি। ২০১৪-র এপ্রিল থেকে ২০১৫-র মার্চ শুধু এই এক বছরে রুগ্‌ণ হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প সংস্থা।

কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে চিত্রটি কিছুটা অন্যরকমই ছিল। রাজ্যের ছোট, মাঝারি ও কুটির শিল্প দপ্তরের তথ্য অনুসারে ২০১১-র মার্চে রুগ্‌ণ শিল্প সংস্থা দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৭৯০৪-এ। ওই সময়ে রুগ্‌ণ মাঝারি শিল্প সংস্থা ছিল ৪১৬টি। তথ্য রাজ্যের ব্যাঙ্কার্সদের। কারণ তাদের মাধ্যমেই ছোট, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পের ঋণ এবং সরকারি ভরতুকির টাকা পান আবেদনকারীরা।

বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে রুগ্‌ণ শিল্প সংস্থার সংখ্যা নিয়ে নানা প্রচার করতেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা। রাজ্যের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯-র মার্চ থেকে ২০১১-র মার্চের মধ্যে রাজ্যের রুগ্‌ণ ছোট এবং ক্ষুদ্র শিল্পে এক বিপুল উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছিল। ২০০৯-১০ আর্থিক বর্ষে রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী কর্মসংস্থান প্রকল্পে ৯৮০৬টি ছোট, ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোগ গড়ে উঠেছিল। এর ফলে কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছিল অন্তত ৮৫ হাজার ৫৫০ জনের। ২০১৪-১৫-তে তা মমতা ব্যানার্জি ২৪ হাজার ৬৪৬-এ নামিয়ে আনতে পেরেছেন! সহায়তা পাওয়া ছোট শিল্প সংস্থার সংখ্যা ২০১৪-১৫-তে ৩৩৯৭!

কর্মসংস্থানের সুযোগ সংক্রান্ত জাতীয় নমুনা সমীক্ষার সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০০৪ থেকে ২০১১ এই সময়কালে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে দেশে মোট ৫৮লক্ষ ৭০ হাজার কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তার ৪০শতাংশ একা তৈরি করেছিল পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সরকার। রিপোর্ট বলছে, ওই সাত বছরে ৫৮লক্ষ ৭০ হাজারের মধ্যে একা পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়েছিল ২৪লক্ষ অর্থাৎ মোটের ৪০শতাংশ। আর সেখানে দ্বিতীয় স্থানে ছিল নরেন্দ্র মোদীর গুজরাট। সেখানে তৈরি হয়েছিল ১৪ লক্ষ ৯০ হাজার কাজের সুযোগ। যা পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেকটাই কম।


No comments:

Post a Comment