20160404

৬৮লক্ষ চাকরি কোথায়, মিলছে না হিসেব

পীযূষ ব্যানার্জি

------------------------------------
মাধ্যমিক স্কুলশিক্ষকের শূন্যপদ ৩৫হাজার
--------------------------------------
 সাল     পি এস সি-তে আবেদনকারীর সংখ্যা
২০১০         সাড়ে ৩লক্ষের বেশি
২০১১          ১লক্ষ ৪০হাজার (প্রায়)
২০১৩          ২০হাজার
------------------------------------
মেয়াদ                বেসরকারি বিনিয়োগ প্রস্তাব (টাকা)
২০০৬-১১               ৫লক্ষ ৬৩হাজার কোটি
২০১১-১৪                ৩৯হাজার ৫৯৬কোটি
----------------------------------------
জাতীয় নমুনা সমীক্ষার হিসেব: বাস্তবায়িত শিল্প প্রস্তাব
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ১০শতাংশ
তৃণমূল  সরকারের  সময়ে ২.৬শতাংশ
------------------------------------


এত বড় সাফল্য!

কিন্তু কী বিনয়ী সরকার। কোথাও তুলে ধরা হয়নি এমন সরকারি সাফল্যকে।

রাস্তায় টাঙানো হোর্ডিংয়ে সরকারের হরেক সাফল্যেরনজির। টিভির পর্দা থেকে খবরের কাগজজুড়ে ছড়িয়ে আছে শুধু সাফল্য আর সাফল্য। কিন্তু এত বড় একটা সাফল্যের কোনো প্রচার নেই। কোথাও নেই একটা ছিটেফোঁটা বিজ্ঞাপন।

অথচ এত বড় সাফল্যের খবর রাজ্যবাসীর জন্য বয়ে এনেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।

কী সেই সাফল্যের খবর?

মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, গত সাড়ে চার বছরে রাজ্যে ৬৮লক্ষ বেকারের চাকরি হয়েছে! এত বড় সাফল্যের শরিক এই ৬৮লক্ষ’, তাঁরা কারা?

রাজ্যে প্রাথমিকে নিয়োগ নেই। স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে মাধ্যমিকে নিয়োগ বন্ধ। রাজ্যে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সংস্থা পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পি এস সি) এখন ঠুঁটো। ২০১০সালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পি এস সি-র মাধ্যমে প্রথম রাজ্যে গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিলো। ওই বছরের এপ্রিল মাসে ১৩লক্ষ আবেদনকারীর মধ্যে ৯লক্ষ আবেদনকারী পরীক্ষায় বসেছিলেন। চারদিন ধরে রাজ্যজুড়ে গ্রুপ ডি পদে পরীক্ষা নিয়ে ২১হাজার সফল পরীক্ষার্থীর প্যানেল তৈরি করে পি এস সি।

২০১০সালে পি এস সি-র গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের জন্য আবেদনকারী সংখ্যা ছিলো ১৩লক্ষ। তার সঙ্গে ডব্লিউ বি সি এস, মিসলেনিয়াস পরীক্ষার্থী ধরলে আবেদনকারীর সংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে ১৬লক্ষের ওপর। অর্থাৎ, গ্রুপ-ডি বাদে পি এস সি-তে বাকি আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩লক্ষের বেশি। 

মমতা ব্যানার্জির আমলে ২০১১সালে পি এস সি-র মাধ্যমে সবমিলিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা ছিলো ১লক্ষ ৪০হাজারের কাছাকাছি। ওই বছর থেকেই গ্রুপ-ডি নিয়োগ কার্যত বন্ধ। ২০১২সালে ডব্লিউ বি সি এস, ‘গ্রুপ এ’-র সঙ্গে মিসলেনিয়াস পরীক্ষা মিলিয়ে আবেদনকারীর সংখ্যা ছিলো ২লক্ষ ৯০হাজার। ২০১৩সালে পিএসসি-র মাধ্যমে নিয়োগের পরীক্ষায় আবেদনের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ২০হাজারে। এরপর তো পি এস সি-র হাত থেকে চাকরির পরীক্ষার নেওয়ার সব ক্ষমতাই কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু কোনো হিসেবেই পি এস সি-র মাধ্যমে নিয়োগে বামফ্রন্ট সরকারকে অতিক্রম করতে পারেনি তৃণমূল সরকার।

নিয়োগ তো দূরের কথা।এরাজ্য থেকে সরকারি স্তরে চাকরির পরীক্ষা প্রায় উঠে গেছে। তৃণমূল আমলে সরকারি দপ্তরে নিয়োগ বলতে শুধু চুক্তিভিত্তিক কিছু কর্মী নিয়োগ আর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়া কর্মীদের রি-এমপ্লয়মেন্ট।

স্কুল শিক্ষকের চাকরিতে নিয়োগ হয়নি। সরকারি দপ্তরে পড়ে আছে হাজার, হাজার শূন্যপদ। শুধু মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকের শূন্যপদই পড়ে আছে ৩৫হাজার। বছর দুয়েক আগে সরকারি ওয়েবসাইটেও দেওয়া এই তথ্য এখন উধাও। ফলে শুধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই শূন্যপদের সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। নিয়োগ নেই। তাহলে এই ৬৮লক্ষচাকরি পাওয়া বেকার যুবক-যুবতী কারা? রাজ্যের বেকার যুবক যুবতীরাই এখন হন্যে হয়ে তাদের নিজের এলাকায় ৬৮লক্ষেরকোনো একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এখন ৬৮লক্ষতে থেমে নেই। ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে বাড়ছে তাঁর চাকরিদেওয়ার বহর। এই তো সেদিন উৎকর্ষ বাংলানাম দিয়ে নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে তিনি ঘোষণা করে বসলেন,‘‘৬৮লক্ষের চাকরি দেওয়া হয়ে গেছে।আরও ২লক্ষ ছেলেমেয়েকে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রসেস চলছে।’’

তাহলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হিসাব বলছে, ৭০লক্ষ বেকার ছেলেমেয়ে এই পাঁচ বছরে চাকরি পেয়েছেন।

কিন্তু কোথায় কতো চাকরি? কোন কোন ক্ষেত্র থেকে চাকরি হলো? তার কোনো জবাব সরকারের কেউ দিতে চাইছে না। সরকারি ক্ষেত্রে চাকরির হাল দেখা গেছে। তাহলে কী বেসরকারি ক্ষেত্রে পাঁচ বছরে দেদার চাকরি মিলেছে?

কী বলছে রাজ্যের শিল্পায়নের হাল?

২০০৬থেকে ২০১১সালের মে মাস পর্যন্ত এরাজ্যে বিনিয়োগের প্রস্তাব ছিলো ৫লক্ষ ৬৩হাজার কোটি টাকা। আবার ২০১১সালের জুন মাস থেকে ২০১৪সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই চার বছরে এরাজ্যে ৩৯হাজার ৫৯৬কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব জমা পড়েছে।

শুধু বিনিয়োগের প্রস্তাবের হিসাবেই বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পাঁচ বছরের সঙ্গে তৃণমূল সরকারের চার বছরের তুলনা টানলে মমতা ব্যানার্জি ১৫গুণ পিছিয়ে আছেন। আবার সব প্রস্তাব থেকে শিল্প বাস্তবায়িত হয় না।

জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য বলছে, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শিল্পে বাস্তবায়িত বিনিয়োগের হার ১০শতাংশ। সেখানে তৃণমূল আমলে বিনিয়োগ বাস্তবতার হার মাত্র ২.৬শতাংশ!

বিনিয়োগ থেকে শিল্প স্থাপন কোনো ক্ষেত্রেই বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পাঁচ বছরের সঙ্গে ন্যূনতম প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে পারেননি মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু সরকারের তথ্য নিয়ে কোনো দায় নেই। মুখ্যমন্ত্রীর নেই। শিল্পমন্ত্রীরও নেই।

গত ২০১৫সালে রাজ্যের বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেছিলেন,একবছরে রাজ্যে নতুন করে সাড়ে ১৭লক্ষ কর্মসংস্থান হবে। সেই তথ্যের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘‘কর্মসংস্থান মানে একশো দিনের কাজের মতো কাজ নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাড়ে ১৭ লক্ষ চাকরি হবে। চাকরি মানে চাকরিই। অন্য সব কর্মসংস্থানের হিসাব ধরলে আমরা একবছরেই ৫০লক্ষ থেকে ১কোটি কর্মসংস্থান পার করে ফেলেছি।’’

এখন যে ৬৮লক্ষচাকরির হিসাব মমতা ব্যানার্জি দিচ্ছেন তা তো এক বছর আগেই কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

কিন্তু এত বড় সাফল্য নিয়ে সরকারের কোনো বিজ্ঞাপন নেই। প্রচার নেই। শুধু ৬৮লক্ষের একটা হিসাব। কোন কোন ক্ষেত্র থেকে এই নিয়োগ হয়েছে সরকার জানিয়ে দিক। কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপনে খরচ করে এত বড় সাফল্যের বিজ্ঞাপনে এক টাকাও খরচ করেনি। এত বড় সাফল্য প্রচারের দায় শুধু নিজের ওপর রেখে দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি।

এত বড় সাফল্যশেষ পর্যন্ত এত বড় সত্যিইহয়ে উঠবে না তো! 

No comments:

Post a Comment