20160412

মেগালোম্যানিয়াক

মানব মুখার্জি

অসুখটার নাম মেগালোম্যানিয়া (Megalomania) এই অসুখে আক্রান্ত রোগীকে বলা হয় মেগালোম্যানিয়াক। রোগ হিসাবে এটি খুবই পরিচিত, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় এই অসুখ এবং অসুস্থদের নানা বিবরণী। নানা ইতিহাসবিদ নানা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে মেগালোম্যানিয়াক বলেছেন। কিন্তু সবার তালিকায় তিনটি নাম কমন। রোমের সম্রাট নিরো, জার্মানির ফুয়েরার অ্যাডলফ হিটলার এবং ইতালির ডুচে বেনিতো মুসোলিনি।

ডিকশনারিতে মেগালোম্যানিয়া সম্পর্কে বলা হচ্ছে – Megalomania is a psychopathological condition charecterized by fantasies of power relevance, omnipotence and by inflated self esteem. অর্থাৎ মেগালোম্যানিয়া এক ধরনের মনরোগগ্রস্ত অবস্থা, যাতে রোগী নিজেকে পরম ক্ষমতাসম্পন্ন বলে মনে করে। নিজেকে ভাবে পরমশক্তিশালী এবং নিজের সম্পর্কে এক কল্পিত উচ্চ ধারণা পোষণ করে।

ব্যক্তিগত জীবনে মেগালোম্যানিয়াক দুচার জনকে সবাই খুঁজে পাবেন। আমাদের সাহিত্যের পৃষ্ঠাতেও মেগালোম্যানিয়াকদের আনাগোনা আছে। বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মেগালোম্যানিয়াক চরিত্র লীলা মজুমদারের ‘পদিপিসির বর্মীবাক্স’-র পদিপিসি। কিন্তু সাহিত্যের মেগালোম্যানিয়াকরা বাস্তব জীবনে বিশেষ সমস্যা তৈরি করে না, তৈরি করে বাস্তব জীবনের মেগালোম্যানিয়াকরা।

লীলা মজুমদারের পদিপিসি আমাদের সমস্যা না। সমস্যা অভিষেক ব্যানার্জির ছোটো পিসি, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি একজন আদর্শ মেগালোম্যানিয়াক। তিনি যা বলবেন সেটাই এরাজ্যের সিদ্ধান্ত। তিনি যা ভাববেন সেটাই সবাইকে ভাবতে হবে। তাকে কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। কারুর পরামর্শ তার প্রয়োজন নেই। তিনি সমস্ত জ্ঞানের আধার। তাকে কুর্ণিশ করাটাই এই রাজ্যের ৯কোটি মানুষের কাজ। উনি চান তাই গোটা রাজ্যকে নীল সাদা রঙে রাঙানো হলো। উনি চান তাই সত্যজিৎ রায়ের বাসভবন বিশপ লেফ্রয় রোডে, সেই নাম পালটে করা হলো সত্যজিৎ ধরণী। রাস্তার নাম ধরণী’ — ভূভারতে কেউ কখনও শোনেনি। কিন্তু উনি ভেবেছেন।

অথচ রাস্তার নামকরণের জন্য প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের নিয়ে একটি কমিটি আছে। কিসের বিশেষজ্ঞ? আমাদের রাজ্যে একমাত্র বিশেষজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রী (মেগালোম্যানিয়াকরা ঠিক এরকমই মনে করে)। এখন সত্যজিৎ রায়ের পুত্র কান্নাকাটি করছেন — ‘দোহাই, রাস্তার নাম ফিরিয়ে দিন। তাতে অবশ্য কোনো লাভ হয়নি। কেউ যদি মনে করেন এই অভিযান এখানেই শেষ তিনি ভুল প্রমাণিত হতেই পারেন। ধরণী’-তে বিষয়টা থামবে বলে মনে হয় না। কাল হতেই পারে রবীন্দ্রনাথকে চিরজীবী করতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সামনের রাস্তা রবীন্দ্র সরণির নাম পাল্টে করে দিলেন রবীন্দ্র মরেনি। এ সবই সম্ভব।

একজন গড় সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ জানেন সাঁওতাল বিদ্রোহের দুজন নেতা সিধো এবং কানহু। সেখানে একজন ডহরবাবু বা তার পরিবারের সদস্যদের একদম ভরা বাজারে মাইকে ডেকে পাঠানোটা বাড়াবাড়ি রকমের অজ্ঞানতা, কিন্তু অজ্ঞানতা অপরাধ নয় কাজেই ক্ষমার্হ। কিন্তু কবি জন কিটস (মৃত্যু - ১৮২১) এবং শেলী (মূত্যু - ১৮২২)-এর সাথে শেকসপিয়রকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের (জন্ম - ১৮৬১) জ্ঞানগর্ভ আলোচনার উৎস একটি প্রহেলিকা ছাড়া কিছুই না। কি করে জানলেন? নিশ্চয়ই কোনো বইয়ে পড়েননি, নিশ্চয়ই কেউ বলেননি। স্রেফ উনি ভেবেছেন। আর যেহেতু তিনি মেগালোম্যানিয়ায় আক্রান্ত তাই যেটা ভেবেছেন সেটাকেই সত্য বলে জেনেছেন।

মুখ্যমন্ত্রী আমাদের আবার রবীন্দ্রপ্রেমী। কথায় কথায় তিনি রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনেন। তাই অবলীলাক্রমে ১৯৪১ সালে প্রয়াত কবি ১৯৪৬ সালে বেলেঘাটায় এসে মহাত্মা গান্ধীর অনশন ভাঙাতে তাঁর হাতে ফলের রসের গ্লাস তুলে দেন কারণ তিনি ভেবেছেন। একইভাবে ১৮৬১-তে প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ১৮৩৩-এ প্রয়াত রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে এসে বক্তৃতা দিয়ে যান। এবং এ কথা ভুলবশত একবার বলে ফেলেননি, দুদুবার বলেছেন। কারণ তিনি যা ভাবেন তাই অভ্রান্ত, ১০০% খাঁটি সত্য।

তবে এই সব অসংখ্য মণিমুক্তার ভাণ্ডার জনজীবনে খুব বিপজ্জনক হয়ে ওঠে না। বড়জোর আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর কেউ যদি বই লেখেন রাজ্য রাজনীতিতে হাস্যরসতবে এইসব তাতে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আমাদের উত্তরসূরিরা এই সব পড়ে হেসে কুটিপাটি হবেন। কিন্তু মেগালোম্যানিয়াক রাজনীতিকদের কীর্তি এতটা নিরামিষ হয় না, এর সাক্ষ্য দিচ্ছে ইতিহাস। মেগালোম্যানিয়াকের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট হলো এক, নিজেকে সর্বশক্তিমান ভাবা, দুই, নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবা। অর্থাৎ তিনি বাকিদের মতো নাতিনি সবার ওপরে। উনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে এই মনোভাবই সমস্ত মেগালোম্যানিয়াককে স্বৈরাচারী বানায়। সাধারণ মানুষের কাজ তাকে অনুসরণ করা। যদি করে তবে ভাল, আর না করলে তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য করতে হবে।

২০১১-র পরের কোনো নির্বাচনে মানুষ অবাধে ভোট দিতে পারেনি। পরাজয় দূরে থাক কোনো নির্বাচনে তার সমর্থন কমে যাওয়াটাও একজন মেগালোম্যানিয়াক নেতা সহ্য করতে পারেন না। কেবল লোকসভা, পঞ্চায়েত বা পৌরসভার মতো রাজনৈতিক ভোট না, ছাত্র সংসদ থেকে কো-অপারেটিভ, পাড়ার ক্লাব থেকে স্কুল কমিটি সব নির্বাচনেই সরকারি দল গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঢালাও নির্দেশ — ‘অন্যরা যাতে একটি আসনও না পায় সেটা দেখতে হবে।এই নির্দেশ কেবল দলের কাছে যায় না, সাধারণ এবং পুলিশ প্রশাসনের কর্তাদের কাছেও এই নির্দেশ যায়। স্টিং অপারেশন খ্যাত শ্রীযুক্ত মির্জা বা ভারতী ঘোষের মতো পুলিশ কর্তারা ঠিক এই কাজ করেছে পঞ্চায়েত বা পৌরসভা নির্বাচনে।

এটা কাকতালীয় কিনা জানি না। ক্ষমতায় আসার পর হিটলার এবং মুসোলিনি দুজনেই প্রশাসন এবং দলকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন, যেটা এই রাজ্যে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই কাজ করার জন্য দল এবং প্রশাসনকে বিশেষভাবে তৈরি করতে হয়। অন্যকে সহমতে আনার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। ২০১১-র আশপাশে তৃণমূলের মিটিং-এ মিছিলে বড় সংখ্যায় থাকতো সেই কর্মীরা যারা মানুষকে সহমতে আনতে পারে। কিন্তু এই অংশের প্রয়োজন ক্রমশ ফুরিয়েছে তৃণমূলের কাছে, তাদের দরকার ভোট লুট করার বাহিনী, তাদের দরকার প্রতিপক্ষ মুখ বন্ধ করার বাহিনী। তাদের দরকার মানুষকে ভয় দেখানোর বাহিনী, পায়ে হাঁটা মিছিলের বদলে বাইকবাহিনীকে বেশি দরকার।

বিধাননগরের পৌরভোটে টিভিতে আমরা দেখেছি মাটিতে ফেলে ৭০বছরের বৃদ্ধর বুকে লাথি মারা হচ্ছে। এরা রাজনৈতিক কর্মী হতে পারে না, এরা পেশাদার সমাজবিরোধী। কেন আসে এরা তৃণমূলের সাথে? নবান্নতে দিদিআছেন মানে এরা করে খেতে পারবে।তোলাবাজি, সিন্ডিকেট এগুলোই তো এদের কাজ। এই করে এরা খায়। তৃণমূলের রাজনীতি দেখে এরা আসে না। অর্থনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এরা আসে। কাজেই যে কোনো মূল্যে এরা তৃণমূল ক্ষমতায় থাকুক এরা চায়। পাঁচ বছরে তৃণমূল দলের চেহারা পালটে গেছে। তৃণমূলের নেতা এখন অনুব্রত, আরাবুল, কাজল শেখ, মণিরুল, কানকাটা দিলীপ বা রানিগঞ্জের এম এল এ সোহরাব আলিরা। দল ছেড়ে চলে গেছেন পঙ্কজ ব্যানার্জি, এই বাহিনীর হাতে বেধড়ক মার খেয়েছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। এটাই এখনকার তৃণমূল।

২০১০-এ মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন আমি অনেক গুন্ডা কন্ট্রোল করিআর এখনকার বাস্তবতা হলো গুন্ডারা ওনাকে এবং ওনার দলকে কন্ট্রোল করে। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতাই মেগালোম্যানিয়াকের লক্ষ্য। কোন্ পথে তা আসলো তা তার দেখার দরকার নেই। রানিগঞ্জের এম এ এ সোহরাব আলি লোহা চুরির মামলায় অপরাধী সাব্যস্ত হলেও তাকে তিনি সরান না। জেলে গেলেও মদন মিত্রকে মন্ত্রী রাখেন এবং প্রার্থী করেন। যারা নারদ স্টিং অপারেশনে ধরা পড়ল সেই সব তৃণমূল নেতারা জানেন নেত্রী তাদের কিছু বলবে না বরং তাদের পাশে দাঁড়াবেন। হিটলারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর হেরম্যান গোয়েরিং লুট করে ইউরোপের সবচেয়ে বড়লোকে পরিণত হয়েছিলেন। তার জমির পরিমাণ ছিল ১লক্ষ একর বা ৪০০ বর্গ কিলোমিটার। প্যারিসের মিউজিয়াম থেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্প সামগ্রী লুট করে এনেছিলেন। সেই সব জিনিসের পরিমাণ এতটাই ছিল ২৬টি ট্রেন বোঝাই করে তা আনতে হয়েছিল। এতে গোয়েরিং-এর ওপর হিটলারের আস্থা বিন্দুমাত্র কমেনি। কারণ হিটলারের নিজের ক্ষমতার প্রধান স্তম্ভ ছিলেন গোয়েরিং।

পৃথিবীর সমস্ত মেগালোম্যানিয়াক স্বৈরাচারী শাসকদের অধিকাংশই ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতিপরায়ণ। কয়েক বছর আগে গ্রিস যখন তার বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে পারছে না, তখন তার নিলামে তুলেছিল রোডস দ্বীপে মুসোলিনির প্রাসাদ তার দাম উঠেছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার।

আমাদের রাজ্যের মেগালোম্যানিয়াক ভদ্রমহিলাটি একসময় নিজেকে সততার প্রতীক বলে প্রচার করতেন। চাপে পড়ে এখন সেসব করেন না। ডেলোর পাহাড়ী বাংলোর মধ্যরাতে চিট ফান্ড মালিকদের সাথে গোপন মিটিং, রহস্যজনক ক্রেতাদের কাছে কোটি কোটি টাকার ছবি বিক্রি এসবের উত্তর তিনি দিতে পারছেন না। দিতে পারছেন না তার ভাইয়েদের হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির, এমনকি দিল্লির ফাইভ স্টার হোটেলে ভাইপোর ১১কোটি টাকার বিয়ের। স্বৈরাচার শেষ বিচারে দুর্নীতির উৎস। এবং দুর্নীতি এক জায়গায় দাঁডিয়ে থাকে নাতা প্রসারিত হয়। পাঁচ বছরে এই রাজ্য সৎ মানুষদের জেলখানা এবং চোরেদের মুক্তরাজ্যে পরিণত হয়েছে। দল, নেতা, নেত্রী, প্রশাসনের একটা অংশ সবাই এ পথের যাত্রী। যদি উনি জিতে চান এই রাজত্ব প্রসারিত হবে, কারণ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাও তিনি বি জে পি-র সাথে সমঝোতা করে ম্যানেজ করে নিয়েছেন।

মেগালোম্যানিয়াকের স্বাভাবিক চরিত্র সে আইন মানে না, আইনের প্রতিষ্ঠান মানে না, নিজেকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে করে। কিন্তু এখন মমতা ব্যানার্জির কাছে এটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য না, তার আত্মরক্ষার এক মাত্র পথ। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে তার রাগ ফুটে বেরোচ্ছে প্রতিটি বক্তৃতায়। আদালত সম্পর্কে তার প্রকাশ্য অবজ্ঞা তো আমরা গত পাঁচ বছর ধরে দেখছি। কাজেই শেষ চেষ্টা তিনি করবেন যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে। তিনি একটি পথই জানেন তা হলো লুট। এবারে এটা করবার মতো সাহস তিনি অর্জন করতে পারবেন কি না এটাই প্রশ্ন। এবারই প্রথম তিনি ভয় পেয়েছেন। কাজটা তার পক্ষে কঠিন। তিনি জানেন সব কিছু তিনি ম্যানেজ করতে পারবেন, পারবেন না বাংলার মানুষকে ম্যানেজ করতে।

মেগালোম্যানিয়াকদের শেষ যখন আসে তারা থাকে একা। সম্রাট নিরোর সাথে ছিল তার সঙ্গিনী। বার্লিনের মাটির নিচের বাংকারে হিটলারের সাথে একমাত্র ছিল ৪০মিনিট আগে যাকে বিয়ে করেছিলেন সেই এভা ব্রাউন। মুসোলিনীকে ধরে ফেলেছিল মিলানের পার্টিজান সৈনিকরা, তাকে মেরে ওরা ঝুলিয়ে দিয়েছিল ল্যাম্পপোস্টে। মিলানের শ্রমিক মহল্লা থেকে দল বেঁধে এসেছিল না খেতে পাওয়া হার জিরজিরে মেয়েরা, ঝুলন্ত দেহটাতে থুতু দিতে।

আমাদের মেগালোম্যানিয়াকও ক্রমশ একা হয়ে আসছেন। ২০১১-তে তাঁর সাথে ছিল সবাই। বামপন্থীরা ছিল একা। ৫বছর পর তার কেউ নেই। সবাই তার বিরুদ্ধে। উনি একা হয়ে আসছেন। মেগালোম্যানিয়াকের শেষ সময় ঘড়ির কাঁটার সাথে ক্রমশ এগিয়ে আসছে।-- 

No comments:

Post a Comment