শ্রীতিভ
বামপন্থাকে অপ্রাসঙ্গিক এবং অচল রাজনৈতিক দর্শন বলে
যে বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা আকাশ বিদীর্ণ করেছেন
তারাই আজ পুঁজিবাদী সংকটের গভীরতায় এবং ব্যাপকতায় দিশাহারা। তল পাচ্ছেন না।
একটার পর একটা ‘দাওয়াই’
প্রয়োগ করেও সংকট থেকে
মুক্ত হতে পারছেন না। তাদের সৃষ্ট ‘নয়া-উদারবাদী’ অর্থনীতি ঘরে বাইরে আজ কঠিন প্রতিরোধের সম্মুখীন। এ হেন সংকটকালে এদেশের
একদল পণ্ডিত অহরহ বামপন্থার ত্রুটি বিশ্লেষণে অকৃপণ শব্দ ব্যয় করে চলেছেন। অথচ এই
ক্লান্তিহীন প্রয়াসের মধ্যেই কখন যে সিঁদ কেটে সমাজে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তনের
অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেটা বৌদ্ধিক গোষ্ঠীর বেশিরভাগের নজর এড়িয়েছে বা সরকারি খেতাব আর
বদান্যতার লোভনীয় হাতছানিতে নজর দেওয়ার কথা মনেই আসেনি। পুঁজির কেন্দ্রীভবন বা
বাণিজ্যের একচেটিয়াকরণ আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতে আধুনিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে রক্ষণশীল
ভাবনা। একদিকে বিজ্ঞানের কারিগরি বিকাশের হাত ধরে মঙ্গলগ্রহে অভিযান চলেছে
অন্যদিকে চলেছে বেদ-উপনিষদ-পুরাণকে আধুনিক শিক্ষার পাঠক্রমে স্থান করে দেবার গৈরিক
তৎপরতা। ফ্যাসিবাদের জমি তৈরি হচ্ছে দ্রুততার সাথে। ফ্যাসিবাদ শুধু হিংস্রতা আর
জবরদস্তির মধ্যেই থেমে থাকে না-মানুষের যুক্তিশীল মননকে ধ্বংস করে গড়ে তোলে অন্ধ
জাত্যভিমান-ফ্যানাটিজম। দেশের বিপুল কর্মহীন যৌবনের হতাশার মধ্যেই লালিত হয়
গোঁড়ামির প্রতি অনুরাগ-যাকে হাতিয়ার করে ক্ষয়িষ্ণু লুম্পেন পুঁজি।
এদেশে কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে।
সংবাদে প্রকাশ যে সম্প্রতি উত্তর প্রদেশে ৩৬৮টি পিওন পদের চাকরির জন্য ২৩লক্ষ
আবেদনপত্র জমা পড়েছে যার মধ্যে ২৫৫ জন পি এইচ ডি! যদি সকলের ইন্টারভিউ গ্রহণ করা
হয় (২৪x৭দিন) তাহলে প্রায় সাড়ে চার বছর সময় লাগবে বলে অনুমান! এ রাজ্যেও ‘টেট’ পরীক্ষায় ২৩ লক্ষ আবেদনপত্র পড়েছে ২৩ হাজার
পদের জন্যে! এই ভয়ংকর কর্মহীনতার পশ্চাতে রয়েছে নয়া উদারবাদী অর্থনীতি। অতিরিক্ত
মুনাফার লক্ষ্যে জাতীয় পুঁজি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে। সামাজিক
সুরক্ষার দায় অস্বীকার করে অনিশ্চয়তার আর্থিক শৃঙ্খলে সে আবদ্ধ করতে চায় শ্রম
ব্যবস্থাকে। একচেটিয়া পুঁজির এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে আড়াল করে এদেশে বৃহৎ পুঁজির
প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলি অনৈতিহাসিক যুক্তির অবতারণা করছে। দক্ষিণপন্থী শক্তির
শাসনে বর্তমানে যে ভাবনা রাষ্ট্রীয় দর্শনে পরিণত। ছত্তিশগড়ে দশম শ্রেণির
পাঠ্যপুস্তকে কর্মহীনতার কারণ হিসাবে মহিলাদের চাকরি করাকেই দায়ী করা হয়েছে! (TOI-26.09.2015) যে-কোন রাষ্ট্রের উন্নয়নের সূচক সে দেশের
নারীদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি। বলাবাহুল্য ভারতের চিত্রটি এক্ষেত্রে
সামন্তবাদী পশ্চাৎপদ ভাবনায় লাঞ্ছিত। ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়াশীল
সাংস্কৃতিক ভাবনাই এদেশের বুর্জোয়া দলগুলি পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। ব্যক্তি
স্বাধীনতা-নারীর সম্মান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নির্বাসিত। চরম অসাম্য আর বিপুল
কর্মহীনতার এই অন্তহীন বেদনা এবং ধূমায়িত ক্ষোভকে প্রশমিত করার দায়িত্ব অস্বীকার
করে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই বিকাশলাভ করতে পারে না।
বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির দুনিয়ায় ঘনায়মান অন্ধকারের
পেছনে রয়েছে সমন্বিত বহুজাতিক পুঁজির বাজার সংকট। সেই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্যেই
চলেছে গরিব এবং উন্নয়নশীল দেশের ওপর বৃহৎ পুঁজির খবরদারি-তাদের বাজার চাই। আর
বাজার না থাকলে সরকারকেই মুনাফার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এ দেশে গৈরিক শাসনে ঠিক
সেই কাজটিই আমরা প্রত্যক্ষ করছি। শ্রম আইন পরিবর্তন,
রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের
বেসরকারিকরণের নামে বিলোপসাধন, জমি বিল সহ দেশের
প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি মালিকদের হাতে দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সবই দেশীয়
এবং বহুজাতিক পুঁজির মুনাফার গ্যারান্টি। একাজে দেশের আঞ্চলিক এবং বৃহৎ বুর্জোয়া
দলগুলির মধ্যে আপাত বিরোধিতা থাকলেও পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে এদের দ্রুত ঐক্য
স্থাপিত হয়। বাইরের আচরণে যাই থাক না কেন রাজনৈতিক শ্রেণিস্বার্থে এরা অভিন্ন।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিমাশিল্প বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যে বিলের ক্ষেত্রে এই শ্রেণি
অভিন্নতা আমরা দেখেছি।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির গভীর সংকটের খোলসেই আশ্রয় নেয়
ফ্যাসিবাদ - ইউরোপের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যার পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতি গ্রিসের ‘কৃচ্ছ্রতাবিরোধী
নির্বাচনে নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে যারা দৃঢ়ভাবে সংগ্রাম করতে সমর্থ
সেই গ্রিক কমিউনিস্ট পার্টি (কে. কে. ই) নির্বাচনে ৫.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অথচ ‘জাতীয়তাবাদী নাৎসি গোল্ডেন ডন’
পেয়েছে ৬.২৮ শতাংশ ভোট।
দ্বিতীয় নির্বাচনেও এই ধারা অব্যাহত। মানুষের দাবির সমর্থনে গড়ে ওঠা আন্দোলনের
নেতৃত্ব যদি যথার্থ প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তির হাতে না থাকে তাহলে সে আন্দোলন
বিপথগামী হবে এবং সম্ভাবনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা পুঁজির কাছেই আত্মসমর্পণ করবে।
এদেশেও হিন্দু মৌলবাদের উত্থান গত শতাব্দীর নাজি
উল্লাসকেই স্মরণে এনে দেয়। সম্প্রতি ভারতে নরেন্দ্র দাভোলকার, গোবিন্দ পানসারে, অধ্যাপক এম এম
কালবুর্গীর হত্যা এক গভীর সামাজিক অন্ধকার আর বিষণ্ণতার ইঙ্গিত বহন করে।
ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল চিন্তনের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনার অর্থ ধর্মান্ধতা আর
পশ্চাৎপদ ভাবনার প্রসার ঘটানো। সাম্প্রদায়িক এবং জাতি দাঙ্গার পটভূমিতেই স্বৈরাচার
আশ্রয় গ্রহণ করে বেড়ে ওঠে। সমাজে যুক্তি বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে তোলাই
আধুনিক শিক্ষার প্রাণসত্তা-গণতান্ত্রিক সামাজিক চিন্তার ভিত্তি। তাই অধ্যাপক
কালবুর্গীর হত্যা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটি সামগ্রিক দার্শনিক ভাবনার
সুনিয়ন্ত্রিত প্রকাশ যা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজের কাঠামোটিকেই ধ্বংসের পথে
নিয়ে যেতে চাইছে। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা
প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। অনেকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন
আকাদেমি পুরস্কার। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর বেপরোয়া আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার
হতে হবে আমাদের সকলের।
‘আচ্ছে দিন’-এর মায়াবী আলোর রোশনাই ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। ফিরে আসছে ধর্মীয় উন্মাদনা আর
হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডা। জনজীবন আকৃষ্ট হয়েছে চটকদারি প্রচারের সাজানো ছবি দেখে।
জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের পেছনেও ছিল পুঁজিপতিদের সক্রিয় সমর্থন এবং জার্মান
জাত্যভিমান যা শেষ পর্যন্ত সভ্যতাকেই বিপন্ন করে তুলেছিল। শুধুমাত্র সোভিয়েত
ইউনিয়নেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২৭ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। ৭ মিলিয়ন
ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। নাৎসি পার্টির ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের
মর্মান্তিক কাহিনী বিশ্বের বিবেককে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল। এই ধ্বংসলীলার কুখ্যাত
নায়ক হিটলারকেই সেদিন জার্মান পুঁজিবাদ দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিল। জনমোহিনী
কর্মসূচির মারফত ক্ষমতাসীন হয়েছিল হিটলার-বাকিটুকু এক মলিন বিষণ্ণ ইতিহাস।
আজ আমরা এমন এক শক্তিকে প্রত্যক্ষ করছি যারা
ফ্যাসিবাদী চরিত্র অর্জনে উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বিষয়টি বিচ্ছিন্নভাবে রাজনৈতিক পরিসরে
আলোচিত হলেও জন আন্দোলনের কার্যক্রমে পর্যবসিত হয়নি। পুঁজিবাদ সংকটের আবর্তে যতই
পতিত হচ্ছে ততই সে জাতীয় বুর্জোয়া দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন রাষ্ট্রকে
স্বৈরতান্ত্রিকতার পথে ঠেলে দিচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতে সাম্প্রদায়িক
শক্তি ক্ষমতাসীন হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে কোন মৌলিক পরিবর্তন সূচিত না
হলেও গণতান্ত্রিক সামাজিক পরিমণ্ডলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে
ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আর কোন অবদান নেই সে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে ফলে
সামাজিক চিন্তায় যুক্তিবাদের পরিবর্তে অতিপ্রাকৃত রক্ষণশীল ভাবনার চর্চাকেই
পরিচর্যা করছে। ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদকে সংহত করার দায় যদি ফ্যাসিবাদী ঝোঁক-সর্বস্ব
কোন দলের হাতে থাকে তাহলে অচিরেই সে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত
হয়।
বিগত লোকসভার নির্বাচন এবং বিশেষ করে এ রাজ্যের বিগত
চারবছরের নির্বাচনগুলিতে প্রশাসনিক সহযোগিতায় দুষ্কৃতীদের জবরদস্তিতে
নির্বাচকমণ্ডলীর স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার কার্যত ‘অবরুদ্ধ স্বাধীনতায়’ পর্যবসিত হয়েছে। অধুনা
এ রাজ্যে স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন একটি অলীক ভাবনা। এই কারণেই প্রতিটি
নির্বাচকের স্বাধীন মত প্রকাশের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে প্রসারিত করার কাজটি
গণতান্ত্রিক সংগঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। এ কাজে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের
অংশগ্রহণ সবিশেষ জরুরি। স্বাধীন গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির সমর্থকদের মধ্যে এই
কর্মসূচির ব্যাপক প্রসারলাভ হলে তা প্রত্যক্ষভাবে সমাজচেতনাকে প্রভাবিত করবে, জনচেতনা হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটবে। বামপন্থীরা সব সময়েই মানুষের স্বাধীন মত
প্রকাশের অধিকারকেই স্বীকৃতি দেয় তাকে প্রতিষ্ঠা দেয় - এটাই গণতন্ত্রের ভিত্তি।
No comments:
Post a Comment