ড. অসীম দাশগুপ্ত
এবারের রাজ্য বাজেটে কোনো
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরই উত্তর নেই, কিন্তু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা
আছে। আমরা কিছু মূল বিষয় ও বিভ্রান্তির ওপর আমাদের বক্তব্য রাখছি।
১. কর্মসংস্থান
এই বাজেটে একেবারে শেষের পাতায়
হঠাৎই বলা হয়েছে, এই ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে এ-রাজ্যে ১৩.২৭ লক্ষ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা
হয়েছে (পৃঃ ৩৬)। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের
শ্রম মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী সমগ্র দেশে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতি বছরে কর্মসংস্থান
সৃষ্টি হয়েছে ১.৫ লক্ষেরও কম। তাহলে একটি রাজ্যে কিভাবে ১৩.২৭ লক্ষ মানুষের
কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে? উত্তর নেই। এই বিষয়ে অত্যন্ত
প্রাসঙ্গিক হলো জানা যে, রাজ্যের কোন কোন ক্ষেত্রে (যথা,
কৃষি, শিল্প, পরিষেবা
ইত্যাদি ক্ষেত্রে) কত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এই কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো
জেলাওয়াড়ি তথ্য আছে? পুনরায় উত্তর নেই। তাহলে এই ভিত্তিহীন
এবং তথ্যহীন দাবিটি হঠাৎ বাজেটের শেষে একটা বিচ্ছিন্ন পংক্তিতে বলে বেকার
যুবক-যুবতীদের মনে কেন এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হলো?
২. শিল্পে বিনিয়োগ
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি অবশ্যই
নির্ভর করে রাজ্যে মোট উৎপাদন বৃদ্ধি, এবং বিশেষ করে শিল্পের ক্ষেত্রে
বাস্তবায়িত বিনিয়োগের ওপর। এখানে লক্ষণীয় যে, তৃণমূল
কংগ্রেসের নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের প্রথম দু’বছরের আর্থিক
সমীক্ষারই ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৬.৬ সারণির তথ্যাবলী অনুযায়ী, বামফ্রন্ট
সরকারের শেষ বছরে ২০১০ সালে যেখানে সংগঠিত শিল্পের ক্ষেত্রে ৩২২টি নতুন শিল্প
সংস্থায় ১৫,০৫২ কোটি টাকা বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়ে উৎপাদন
শুরু করা সম্ভব হয়েছিল, সেখানে তৃণমূল সরকার আসার পর ২০১২
সালে নতুন চালু হওয়া শিল্প সংস্থার সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কমে দাঁড়ায় মাত্র ১২টিতে,
এবং বাস্তবায়িত বিনিয়োগের পরিমাণও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়ায় ৩১২ কোটি
টাকায়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, এর ঠিক পরের বছরগুলি থেকে
বর্তমান বছর পর্যন্ত রাজ্যের আর্থিক সমীক্ষায় এই সারণিটিই উধাও করে দেওয়া হয়েছে।
তার পরিবর্তে একটি নতুন সারণি বা পরিচ্ছেদ এনে (এ-বছরে পরিচ্ছেদ ৮.৩) নির্মীয়মাণ
শিল্প এবং নির্মিত শিল্প একত্রিত করে দেখানো হয়েছে, কিন্তু
কত পরিমাণ বিনিয়োগ কত নির্মিত শিল্প সংস্থাতে বাস্তবায়িত হয়েছে তা কিছুতেই জানানো
হচ্ছে না। এত গোপনীয়তা কেন?
উল্লেখ করা প্রয়োজন শিল্পে
বাস্তবায়িত বিনিয়োগের তথ্য না থাকলে কিভাবে রাজ্যের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির দাবি করা
হচ্ছে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে?
৩. কর রাজস্ব আদায়
রাজ্যের কর রাজস্ব আদায়ের
ক্ষেত্রে দাবি করা হয়েছে যে ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে ২০১০-১২ সালের তুলনায়, রাজস্ব আদায়
বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণের সামান্য বেশি। কিন্তু যা বলা হয়নি, তাহলো,
বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পাঁচ বছরেও রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে ১০,৮৮৮ কোটি টাকা থেকে ২১,২২৩ কোটি টাকা, যা দ্বিগুণেরও বেশি। এটাও বলা হয়নি যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই
রাজ্যগুলিতে মূল্যযুক্ত কর (ভ্যাট) চালু হয়েছিল, যেখানে
রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার,
এবং যা প্রত্যেক রাজ্যেই কর রাজস্ব বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল। এছাড়া, কর রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগ শুরু হয়েছিল বামফ্রন্ট
সরকারের আমলেই। আত্মপ্রচারের তাগিদে তাও উহ্য রাখা হয়েছে এবারের বাজেট বিবৃতিতে।
৪. পরিকল্পনা ব্যয়
এই বাজেটে বলা হয়েছে রাজ্যের
পরিকল্পনা খাতে ব্যয় ২০১০-১১ এর তুলনায় ২০১৬-১৭-তে ৪ গুণ বৃদ্ধি পেতে চলেছে।
কিন্তু সম্পূর্ণ চিত্রটি একটু ভিন্ন। সাধারণত এরাজ্যে পরিকল্পনা ব্যয় প্রতি চার
বছরের সময়ে দ্বিগুণের মতন বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে, ২০০৯-১০ সালে
রাজ্যে যে পরিকল্পনা ব্যয় ছিল ১২,১২১ কোটি টাকা, তা পরের চার বছরে ২০১৩-১৪ সালে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়ায় ২৪,১০৭ কোটি টাকায়। কিন্তু ঠিক তার পরের বছরেই অর্থাৎ ২০১৪-১৫ সালে রাজ্যের
পরিকল্পনা ব্যয়কে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে দেখানো হল ৪৪,০৪৪
কোটি টাকায়। এবং এখন আগাম বলা হচ্ছে ২০১৬-১৭ সালে তা বৃদ্ধি পাবে ৬ গুণ। এটা কি
করে সম্ভব হচ্ছে? আমরা
জানি যে, কেন্দ্রীয় সহায়তাভিত্তিক প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে
পরিকল্পনা ব্যয়ের একটি অংশ দেয় রাজ্য সরকার, এবং বাকিটা
প্রদান করে কেন্দ্রীয় সরকার। উদাহরণ হিসেবে, যদি কোনো
পরিকল্পনা ব্যয়ের ২৫% দেয় রাজ্য সরকার তাহলে বাকি ৭৫% দেবে কেন্দ্রীয় সরকার।
এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় অর্থ সরকারের প্রদেয় এই অর্থ কেন্দ্রীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত
হবে এবং রাজ্য সরকারের প্রদেয় অর্থটি
রাজ্যের পরিকল্পনা ব্যয়ের অংশ হবে।। কিন্তু গত ২ বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি
যে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ৭৫% অর্থও রাজ্যের পরিকল্পনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে যুক্ত
করে দিয়ে এত বেশি পরিকল্পনা ব্যয় বৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু পদ্ধতির এই পরিবর্তনের কথা রাজ্য সরকার
খোলাখুলি বলছেন না কেন? খোলাখুলি না বলে, উহ্য রেখে নিজেদের কৃতিত্ব হিসেবে দেখাতে চাইছেন কেন?
৫. রাজ্য সরকারের ঋণের বোঝা
এই বাজেটে বলা হয়েছে, ২০০৬-০৭ সালে
বামফ্রন্ট সরকার যে ঋণ নিয়েছিল ১০ বছর পরে এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে ইত্যাদি। আমরা
বারংবার বলেছি যে রাজ্য সরকারের ঋণের বোঝার মূল কারণ হলো, স্বল্প
সঞ্চয় সংক্রান্ত ঋণ। স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প রাজ্য সরকারের নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প। এই প্রকল্পে যে নিয়ম কেন্দ্রীয় সরকার স্থির
করেছে, তাহলো কোনো একটি বছর রাজ্যের সাধারণ মানুষ স্বল্প
সঞ্চয় প্রকল্পে যে অর্থ জমাবেন, তার ৮০% অর্থ
বাধ্যতামূলকভাবেই রাজ্য সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে খুব চড়া সুদে। যেহেতু স্বল্প
সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে এরাজ্যের স্থান হয়েছিল প্রথম, তাই
কেন্দ্রের নিয়মে এই খাতে চাপানো ঋণই বড় বোঝা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওপর। এই
ঋণের বিষয়ে রাজ্য সরকারের কোনো যোগ নেই, তাই কেন্দ্রের এই
চাপানো ঋণের বিরুদ্ধে সমস্ত রাজ্যই বারংবার দাবি জানিয়েছে। ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন
বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার বলার পরও এই ঋণের বোঝা রয়েই গেছে। এই ঋণের আরেকটি
বৈশিষ্ট্য হলো, এর মূলধনের অংশটি ফেরত দিতে হয় ছ’বছরের পর থেকে, এবং ২০ বছর ধরে। এই বিষয়টি কেন্দ্রীয়
ও রাজ্য সরকারগুলির সংশ্লিষ্টসকলেই জানে, এবং তৃণমূল
সরকারেরও জানা উচিত কারণ এই কেন্দ্রীয় নিয়মগুলি যখন লাগু করা হয় তখন তারাও কেন্দ্রীয়
সরকারের অংশীদার। এই প্রেক্ষিতটা না বলে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার
মানে হলো, হয় এই তৃণমূল সরকার এর প্রেক্ষিতটা জানে না,
অথবা জানলেও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
৬. চিট ফান্ডের প্রসঙ্গ
যখন কালো টাকা উদ্ধারের কথা
উত্থাপিত হয়েছে, তখন মনে রাখা উচিত, নিয়ম ভেঙে চিট ফান্ডগুলির লুট
করা টাকা এবং তাদের থেকে পুনরায় ভাগ বসানো অর্থ উভয়ই হলো কালো টাকা। এই মোট কালো
টাকা উদ্ধার করে সঞ্চয়ীদের কাছে ফেরত
দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারকদেরও (দুটি স্তরেই) শাস্তি প্রদানের বিষয়টিতে বিস্ময়করভাবে
একেবারে নীরব থেকে গেছে এই রাজ্য বাজেট।
৭. অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়
আই সি ডি এস প্রকল্পের ক্ষেত্রে
কর্মীদের সহায়তা করার প্রসঙ্গে বলা উচিত, অসংগঠিত অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই
সমস্ত-কর্মীদের (আই সি ডি এস, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী,
শিশু শিক্ষাকেন্দ্র, মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের
সহায়িকা ও সম্প্রসারিকা এবং অন্যান্যদেরও)
ভাতার বিষয়ে একটি নতুন প্রকল্প চালু করেছিল বামফ্রন্ট সরকার, যেখানে সহায়তা প্রদানের পরিমাণ প্রতি ৩ বছর অন্তরই বৃদ্ধি পাবে।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি যে প্রশ্ন
উঠছে, বিশেষ করে সরকারি কর্মী ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে, তাহলো
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বছরে যে অন্তত দু’বার মহার্ঘ ভাতা
প্রদান করা হতো তার কী হলো? এছাড়া, যে
রাজ্য বেতন কমিশন গঠিত হয়েছে তারাই বা কবে সুপারিশ জমা দেবে এবং রাজ্য সরকারই বা
কবে সিদ্ধান্ত নেবে? এই বিষয়গুলির ওপর কোনো উত্তর নেই এই
বাজেটে, এবং নেই কোনো বাজেট বরাদ্দের ইঙ্গিতও।
গণশক্তি, ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
No comments:
Post a Comment