রতন খাসনবিশ
আগামীকাল লোকসভায় পেশ হতে চলেছে
কেন্দ্রীয় বাজেট। লোকসভা নির্বাচনের আগে এটাই শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। তাই ভোটের কথা
মাথায় রেখেই জেটলি পেশ করবেন এই বাজেট। কিন্তু আয়কর ফাঁকি দেওয়া সম্পদশালীদের আঘাত
করার সাধ্য নেই এই সরকারের। বাজেট পেশের ২৪ ঘণ্টা আগে সম্ভাব্য প্রস্তাব বিশ্লেষণ
করেছেন লেখক।
১লা ফেব্রুয়ারি লোকসভায় অরুণ
জেটলি পেশ করবেন ২০১৮-১৯ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট। লোকসভা ভোটের আগে এটা হলো জেটলির
শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। অন্যদিকে এটি হলো জি এস টি চালু হবার পর প্রথম বাজেট। পরোক্ষ
কর এখন আর কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নেই।
অর্থ হলো, কেন্দ্রীয় সরকার কোন পণ্যের ওপর কী হারে উৎপাদন শুল্ক চাপাবে, কোথাও শুল্ক কমবে কিনা, শুল্ক বেড়ে যাবার সম্ভাবনাই
বা কোথায় আছে — বাজেটের আগের কয়েকদিন যা নিয়ে নানা আলোচনা
চলতে থাকে, এ বাজেট নিয়ে সে সব ঘটবে না। কেন্দ্রীয় শুল্ক এখন
জি এস টি-র আওতায়। কেন্দ্রীয় বাজেটে তার লম্বা ফিরিস্তি আর থাকবে না। মন্ত্রীর
বাজেট ভাষণ তাই ছোট হবে, ফিনান্স বিলের আকার কৃশ হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার এই জি এস টি-র জমানাতেও অবশ্য আমদানি শুল্কে হেরফের করতে পারে,
হেরফের হতে পারে রপ্তানি শুল্কেও। কিন্তু সে সবেও আবার বিশ্ব
বাণিজ্য সংস্থার তৈরি করা সীমার মধ্যেই থেকে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। চালু শুল্কে
বড় ধরনের রদবদল ঘটানো সম্ভব নয় এসব ক্ষেত্রে। তাই বাজেটে কোনও চমক থাকবে না এই
অংশেও। থেকে যাচ্ছে আয়কর — ব্যক্তিগত আয়কর আর কোম্পানি কর যা
আদায় করার অধিকার এখনও আছে কেন্দ্রীয় সরকারেরই। এদেশে যারা এখন বছরের শেষে আয়কর
রিটার্ন দাখিল করেন, তাঁদের অর্ধেক কোনও কর দেন না, শুধু রিটার্নটা জমা দিয়ে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করেন। রিটার্ন যা দেওয়া হয় তার হিসাবে, এ
দেশে মাত্র ৩০,০০০ করদাতা আছে বার্ষিক আয় এক কোটি টাকার
ওপরে। যারা আয়কর দেয়, তাদের ৯০ শতাংশের কাছ থেকে তাই পাওয়া
যায় আয়করের মাত্র ২৩ শতাংশ। এই স্তরের করদাতাদের অধিকাংশই সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ
করেন, যেখানে উৎস থেকেই আয়কর আদায় করা হয়। সংগঠিত ক্ষেত্রের
বাইরে কর আদায়ের ব্যবস্থাটা এখনও এদেশে তেমন পাকাপোক্ত নয়। ভোটের আগের শেষ
পূর্ণাঙ্গ বাজেটে জেটলি খুব কড়া কোনও ব্যবস্থা নিয়ে মৌচাকে ঢিল ছুঁড়বেন, এটা আশা করা যায় না। বরং অবস্থার চাপে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মধ্যবিত্তকে
সুখী করতে মোদী সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেটে আয়কর ছাড়ের সামান্য ব্যবস্থা থাকতে
পারে। এক্ষেত্রেও চমকের সুযোগ কম। জেটলির সমস্যা হলো জি এস টি লাগু হয়ে কেন্দ্রীয়
সরকারের পরোক্ষ কর বাবদ আয় কমেছে। কমার কথাই ছিল। পণ্যের ওপর মাশুল বাড়ালে মাশুল
আদায় বেশি হয়, এই নির্বোধের যুক্তিতে প্রথম দিকে জি এস টি
কাউন্সিল এখন ১৭৮টি পণ্যে ২৮ শতাংশ মাশুলের দায় চাপিয়েছিল, যেগুলি
অতিরিক্ত কর ভারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। গত নভেম্বরে জি এস টি হারে ব্যাপক অদলবদল করে
এই ১৭৮টি পণ্যে কর হার ২৮ শতাংশ থেকে ১৮
শতাংশে নামানো হয়েছে। এছাড়াও কর হার কমানো হয়েছে দুশোর বেশি পণ্যে। চড়া হারে জি এস
টি লাগু করায় কর আদায় প্রথমে কমেছে। কর হার কমানোর পর আবার তা বাড়তে শুরু করেছে।
তৎসত্ত্বেও, বাজারের যা অবস্থা, তাতে
জি এস টি থেকে বিশাল কিছু আয়ের আশা নেই। কর হার কমানোর পর ডিসেম্বরে ৮৬,৭০৩ কোটি টাকা জি এস টি আদায় হয়েছে। অঙ্কটি নভেম্বরের চেয়ে বেশি, তবে অনুমান করা হচ্ছে, বাজার চাঙ্গা না হলে এর বেশি জি এস টি আদায় হবে না। কর হার কমিয়েও
জি এস টি অর্থাৎ পরোক্ষ কর থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। রাজস্ব বাড়াবার
তাগিদ তীব্র। প্রত্যক্ষ কর, অর্থাৎ আয়কর আদায় বাড়াতেই হবে।
জেটলি তাই ব্যক্তিগত আয়করে খুব বেশি ছাড় দেবার পক্ষপাতী থাকবেন না। যারা অল্প আয়কর
দেন, সংখ্যায় যারা ১.৫৬ কোটি আয়করদাতার নব্বই শতাংশ তাদের
জন্য আয়করে কিছু ছাড় পাওয়া যেতে পারে
ভোটের রাজনীতির চাপে। তার বাইরে কোনও কিছুই থাকবে না। ব্যক্তিগত আয় যাঁরা লুকিয়ে
রাখেন, ছাপান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতিওয়ালা দিল্লিশ্বর তাঁদের
বিরুদ্ধে কোনও রযা কডিকাল পদক্ষেপ নেবেন না। নেবেন না কারণ তিনি তাঁদেরই লোক।
তাহলে ‘সফেদ ভারত’, ‘না খায়েঙ্গে’
না খাওয়ায়েঙ্গের থেকে’র রাজনীতির কী হলো?
স্পষ্ট বলাই ভালো। ওটা ছিল গদি দখলের জন্য জরুরি কথা। এদেশে বছরে ১
কোটি টাকার বেশি উপার্জন করেন, এমন নাগরিকের সংখ্যা ৩০,০০০ এর অনেক বেশি। তারা বেশ বহাল তবিয়তে আছেন মোদীর জমানায়। নোট বাতিল আর
জি এস টি দিয়ে কী হলো? নোট বাতিল ছিল একটা নির্বোধের চমক
সৃষ্টির চেষ্টা, ভারতীয় ‘নোট’-এর ওপর আপামর ভারতবাসীর আস্থা কমানোই যার একমাত্র দীর্ঘমেয়াদী অবদান। আর
জি এস টি? জি এস টি কোনও সোনার হাঁস নয় যাকে চাঙ্গা রাখলে
বেশি ডিম অর্থাৎ বেশি পরোক্ষ কর আদায় হবে। এদেশে উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি আসে
অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে। জি এস টি সেটাকেই জখম করে দিয়েছে। সরকারি রাজস্ব বাড়ে
অর্থনীতি চাঙ্গা থাকলে। গত চার বছরে সেটাই সবচেয়ে বেশি জখম করেছে মোদী সরকার। শেষ
পূর্ণাঙ্গ বাজেটে সরকারি রাজস্ব আদায় অভূতপূর্ব উন্নতির আশা জেটলি অন্তত করছেন না।
জি এস টি থেকে, ডিসেম্বরে যা আদায় হয়েছে সেটার আসে পাশেই
থাকবে এর পরের আদায়গুলি। ব্যক্তিগত আয়কর থেকে আয় বাড়বে না। কোম্পানি কর-এ আদায়
কী বাড়বে? বাড়ার আশা কম। কোম্পানিগুলি ইতিমধ্যেই হাত তুলে
বসে আছে। তাদের কথা, যে কথাটা একদম খাঁটি কথা, তা হলো, বাজারের অবস্থা একেবারেই ভালো না। বেসরকারি
উদ্যোগপতিরা ভরসা করে লগ্নি করতেই চাইছে না। নতুন লগ্নি হচ্ছে কিনা সেটা বোঝার
একটা সহজ মাপকাঠি হলো কারখানায় নতুন যন্ত্রপাতি বসছে কিনা, নতুন
কারখানা তৈরি হচ্ছে কিনা এবং একই সাথে ব্যাঙ্কের দরজায় সেই উদ্যোগপতিদের দেখা মিলছে
কিনা যারা নতুন প্রকল্পের জন্য ঋণ চায় (টাকা চেয়ে দেদার ধান্দায় যারা ঘোরাফেরা
করে তারা নয়)। চিদাম্বরম দাবি করেছেন এবং তাঁর দাবির পিছনে তথ্যের জোর আছে,
নতুন কারখানা তৈরি, নতুন যন্ত্রাংশ বসানোর
জন্য বিনিয়োগ, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র
ধামাকা সত্ত্বেও একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জি ডি পি-র তুলনায় নতুন লগ্নি কত,
তার হিসাব পাওয়া যায় কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা (সি এস ও) থেকে।
২০১১-১২ সালে এই জি ডি পি-র তুলনায় লগ্নি ছিল জি ডি পি-র ৩৪.৩ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সালে
এই অংশটি নেমে দাঁড়িয়ে ছিল ২৭ শতাংশে, ১৭-১৮ সালে সূচকটির
সম্ভাব্য অঙ্ক হলো ২৬.৪ শতাংশ। তথ্য বলছে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’
ফ্লপ করেছে। কারখানার নতুন যন্ত্রাংশ বৃদ্ধির শতাংশটি ২০১৪-১৫ সালের
এপ্রিল-জুনে ছিল ৩২.২ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর-এর হিসাবে অঙ্কটি
নেমে দাঁড়িয়েছে ২৮.৯ শতাংশে। নতুন বিনিয়োগের প্রস্তাব নেই। সুদের হার কমিয়েও
ব্যাঙ্ক তার সংগ্রহ করা আমানত বিনিয়োগের রাস্তা পাচ্ছে না। ২০১৪-১৫ সালের
এপ্রিল-জুনের হিসাবে ব্যাঙ্ক ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল ১২.৯ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালের
জুলাই-সেপ্টেম্বর-এর ত্রৈমাসিক হিসাবে ঋণ বৃদ্ধির অঙ্কটি নেমে দাঁড়িয়েছে ৬.৫
শতাংশে। মনে রাখতে হবে, ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কে তিনবার সুদের হার
কমানো হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেবার জন্য। উদ্যোগপতিরা
তাকিয়েও দেখেনি। আসলে, বাজার না থাকলে টাকার জোগান বাড়িয়ে যে লাভ হয় না, পানাগাড়িয়ার
মতো পরামর্শদাতারা এই মৌলিক সত্যটাই বুঝতে চান না। ‘হারভাট’-কে ‘হার্ডওয়ার্ক’ দিয়ে ঠেকাবার
নির্বোধ যুক্তি আর কাজ করছে না। হার্ডওয়ার্ক হবে কোথায়। অর্ডার কই? সমস্যাটা আসলে বাজার না বাড়ার সমস্যা। বাজার কেন বাড়ছে না, সেই কথাটা ভাবতে হবে মোদী-জেটলিকে। এই অপ্রিয় সত্যটি ইতিমধ্যেই তাঁদের
বুঝতে হয়েছে যে বিদেশি প্রত্যক্ষ লগ্নি যা আসছে, যেখানে নতুন
কারখানা হচ্ছে তা তাদের বিনিয়োগে যাচ্ছে চালু কারখানা কিনতে কিংবা তার অংশীদারিত্ব
বাড়াবে। তাদের বিনিয়োগ থেকে নতুন কর্মসৃষ্টির আশা নেই। সেটাই হবার কথা। শিল্পে
বিনিয়োগকারীরা এই খবর রাখে যে স্রেফ বাজারের অভাবে এদেশের চালু কারখানাগুলোর
উৎপাদন ক্ষমতার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অলস হয়ে থাকে, বিনিয়োগ করলে
নতুন কারখানা হয়, তারা ভাবে চালু কারখানা কিনবেই। ফলত এই
বিনিয়োগ থেকে নতুন কর্মসৃষ্টি হবে না। কারিগরিতে যদি কিছু বিনিয়োগ হয়, সে বিনিয়োগ কর্ম ধ্বংস করবে শ্রমিক ছাঁটাই করে; যারা
ছাঁটাই হবে না তাদের একই সময়ে বেশি কাজ করতে হবে, মজুরি
বৃদ্ধির কথাই উঠবে না কাজ বাঁচানোর তাগিদে।
মজুরি বাড়ছে না, কারখানা উৎপাদনে
অবস্থা খারাপ। অথচ ডিভিডেন্ট থেকে আয় বাড়ছে ক্রমাগত। ডিভিডেন্ট বাড়ছে কেন, উৎপাদনের হাল যেখানে খারাপ। ডিভিডেন্ট বাড়ছে কারণ সংগঠিত ক্ষেত্রে মজুরি বাড়ছে
না, উৎপাদনের একক প্রতি শ্রমিকের প্রাপ্ত ক্রমশ কমছে। অঙ্কের
নিয়মেই উলটোদিকে তাই মুনাফা বাড়ছে। কোম্পানিগুলির ডিভিডেন্ট বাড়ছে এর ফলে। বাজারে
অর্ডার কমছে, উৎপাদনের হাল খারাপ। মালিকদের তাতে লোকসান নেই।
নতুন বিনিয়োগে তারা সতর্ক। কিন্তু পুরানো বিনিয়োগে ডিভিডেন্ট তারা বাড়িয়ে নিচ্ছে
শ্রমিকের হিস্যা ক্রমাগত কমিয়ে এনে। ডিভিডেন্ট এতটাই ভালো যে অরুণ জেটলি তার আয়
বাড়ানোর সমস্যা কিছুটা মেটাতে পারেন ডিভিডেন্ট বণ্টনের ওপর যে কর সংস্থাগুলিকে
গুনতে হয় তা তুলে নিয়ে বরং ডিভিডেন্টকেই করের আওতায় এনে। ছোট এবং মাঝারি শিল্পে কোম্পানি
কর কমাতে হয়েছে সব বছর। ঝিমিয়ে পড়া বিনিয়োগে গতি সঞ্চার করার জন্য এবার সম্ভবত বড়
শিল্পে (কোম্পানি কর) কমবে। যে আয় ডিভিডেন্ট হিসাবে বণ্টন করা হয় তাতে কর বসিয়ে
সম্ভবত কিছুটা পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করবেন অরুণ জেটলি। আয় আসতে পারে শেয়ার বাজারে
দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভের ওপর কর ছাড়ে কোপ বসিয়েও। সেনসেক্স ৩৬ হাজার ছাড়িয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভের পরিমাণ এখন অনেকটাই বেড়েছে। সেখানে কর বসিয়ে আয়ের রাস্তা
খোলার চেষ্টা করতে পারেন অরুণ জেটলি।
তবে ও রাস্তাতেও বিপদ কম নয়।
সেনসেক্স এতটা বাড়ার কারণ কী? উৎপাদন তো অর্ডারের অভাবে ঝিমিয়ে আছে। অন্যদিকে শেয়ার
বাজার এত চাঙ্গা কেন? কারণটা খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।
গার্হস্থ্য সঞ্চয়ের যে অংশটা ব্যাঙ্কে দীর্ঘমেয়াদি আমানতে জমা পড়ছে, ব্যাঙ্কে সুদের হার ক্রমাগত কমিয়ে তার একটা বড় অংশকে ঠেলা হয়েছে মিউচুয়াল
ফান্ডে। ২০১৬ সালে বাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগ ছিল ৩৫,৭০০
কোটি টাকা। ২০১৭ সালে তা ১ লক্ষ ৭ হাজার কোটিতে পৌঁছেছে। টাকাটা এসেছে
মধ্যবিত্তর গার্হস্থ্য সঞ্চয় থেকে—যার স্বাভাবিক ঠিকানা এখন
আর ব্যাঙ্ক-পেমেন্ট অফিস নয়। এই টাকা শেয়ার বাজারে ঢুকে বাড়িয়েছে শেয়ারের দাম —
যে শেয়ার দামের সঙ্গে উৎপাদন ক্ষেত্রের আর কোনও সম্পর্কই নেই। যদি
দেখা যায় ডিভিডেন্ট-এর ওপর কর বসে আর দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভের রাস্তা বন্ধ করে
এই ফান্ডগুলি থেকে আয়ের অঙ্ক সেই ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসের সুদের কাছাকাছি এসে যাচ্ছে,
তাহলে মিউচুয়াল ফান্ডে টাকার জোগান কমবে, শেয়ার
বাজারে চাহিদা কমবে এবং উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন এই শেয়ার মূল্য বুদবুদের মতোই
ফেটে যাবে। সে সম্ভাবনা প্রবল, কেন না শেয়ার বাজার চাঙ্গা
থাকছে গার্হস্থ্য সঞ্চয় টেনে আর সেটা হয়েছে ব্যাঙ্কে সুদের হার কমিয়ে ঋণ সস্তা
করার সরকারি পদক্ষেপের ফলশ্রুতিতে। জেটলি বিলক্ষণ জানেন, শেয়ার
বাজার এতটা ফুলে ওঠা স্বাভাবিক নয়। এর পর আবার শেয়ারের ডিভিডেন্ট-এ কর বসালে
আর দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভের রাস্তা বন্ধ করলে মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগ কমবে,
ধস নামবে সেনসেক্সে। ভোটের আগের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করতে গিয়ে
এতোটা ঝুঁকি নেবেন কি জেটলি?
জেটলি সম্ভবত সতর্ক থাকবেন আয়কর, কোম্পানিকর,
ডিভিডেন্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভের ওপর কর বসাতে। খরচ কমানোর
চেষ্টা তিনি অবশ্যই করবেন। তবে এ বাজেট যেহেতু ভোটের আগের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট,
যেখানে ভোট আছে সেখানে সরকারি টাকা ঢালতে বিশেষ কার্পণ্য করবেন না।
দরকার হলে রাজকোষ ঘাটতি বাড়াবেন তিনি। বেসরকারি বিনিয়োগ যেহেতু কিছুতেই চাঙ্গা
হচ্ছে না সুদের হার এতোটা কমানোর পরও, সম্ভবত সরকারি বিনিয়োগ
বাড়াবেন তিনি বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে। রাজকোষ ঘাটতি বাড়ানোর আর সরকারি উদ্যোগে
বিনিয়োগ বাড়ানো, আর সেই বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থানের
ব্যবস্থা করা, যে কার্য সংস্থান থেকে ন্যূনতম চাহিদা আসতে
পারে এবং তার ফলে কারখানাগুলো উৎপাদনের নতুন অর্ডার পেয়ে বেসরকারি বিনিয়োগে
উৎসাহী হবে — পানাগড়িয়া মার্কা বাজার মৌলবাদীরা এসব একেবারেই
পছন্দ করেন না। মোদী-জেটলি গত চার বছর শুনেছেন এই বাজার মৌলবাদীদের কথা। নিজেরাও
যাঁরা বাজার মৌলবাদের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী মোদীর ‘মেক ইন
ইন্ডিয়া’ এসেছিল এই পথ ধরেই। তবে ভোটে যাবার আগে এটা তারা
বুঝছেন যে, এসবে ভোট পাওয়া যাবে না। ভোটের কথা মাথায় রেখে এ
বাজেটে সরকারি রাজস্ব কম থাকলেও খরচ ছাঁটাই করবে না। সরকারি বিনিয়োগ বাড়াবে বেসরকারি
লগ্নির অভাব পূরণ করার জন্য। নতুন অর্থবর্ষে যে রেকর্ড পরিমাণ বিনিয়োগের সম্ভাবনা
আছে মূলধনী খাতে, ইতিমধ্যেই তার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে; রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্তাদের দিয়ে ইতিমধ্যেই ২৫০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ
করানো হয়েছে।
পকৌড়া ভেজে ভালো উপায় করার
রাস্তা দেখিয়েছিলেন মোদী, এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যেমন চপের দোকান করে দশতলা বাড়ির মালিক হবার পথ
দেখিয়েছেন। ভারতবাসী এসব কথা যে ভালোভাবে নেবে না সেটা সম্ভবত উপলব্ধি করছেন
জেটলি। রাজকোষে ঘাটতি বাড়াবার ঝুঁকি নিয়েই তিনি মূলধনী খাতে বরাদ্দ বাড়াবেন যাতে
সরকারি উদ্যোগে কিছু নিয়োগ সৃষ্টি হয় এবং তার হাত ধরে চাহিদা বেড়ে বাজার কিছুটা চাঙ্গা হয়। কর্মসংস্থানে
কতটা গতি আসবে এর ফলে সেটা বলা শক্ত; শেষ বেলায় তাড়াহুড়ো করে
এসব করে ভোটে তার সুফল পাওয়া যাবে কিনা সেটাও প্রশ্ন। কিন্তু সে যাই হোক, বছরে দুকোটি নতুন কাজের ধাপ্পা থেকে মুখরক্ষার একটা রাস্তা খুলতে পারে
মূলধনী খাতে বিনিয়োগের বহু পরিচিত কেইনসীয় পথে পা বাড়ালে। জেটলির বাজেট এই পথে
হাঁটলে অবাক হবো না।
রাজস্ব আদায়ে সমস্যা সত্ত্বেও
জেটলিকে কৃষি এবং গ্রামীণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে ভোটের আগের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেটে। এদেশের
অর্ধেক ভোটাররা এখনও মূলত কৃষিনির্ভর। আর কৃষির অবস্থা মোটেই ভালো নয়। মোদী ভোটে
জেতার আগে বলেছিলেন ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে কৃষকের আয় ডবল করে দেবেন
তিনি। হিসাব কষে বছরে ১০ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে কৃষির আয় ঐ লক্ষ্য পূরণের জন্য।
তথ্য এই যে ২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬ সালের মধ্যে কৃষিতে আয় হয়েছে ১.৩৬ শতাংশ। অভাবী
থেকে মহাজনী ঋণ — কোনোটারই বিদায় জোটেনি প্রায় ভারতে। সঙ্গে জুটেছে ফসল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি,
বেড়েছে আত্মহত্যা। গত চার বছরে মোদী সরকার প্রায় কিছুই করে উঠতে
পারেনি কৃষির এই সমস্যা মেটাতে। সেচের জন্য গত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৭,৩৭৭ কোটি টাকা, আর ফসল বিমার জন্য ৯০০০ কোটি টাকা।
কৃষিতে মোট বরাদ্দ ছিল ৫১,০২৬ কোটি টাকা। প্রয়োজনের তুলনায়
এটা যৎসামান্য। এ বছর এই দুই খাতেই সম্ভবত বরাদ্দ বাড়বে। সেটা ভালো কথা। তবে
সমস্যাটা শুধু বরাদ্দ বাড়ানোর নয়। একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করব। ফসল বিমার ক্ষেত্রে
২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে বিমা কোম্পানিগুলি সংগ্রহ করেছিল ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
বিপর্যস্ত কৃষকরা দাবি করেছিলেন ৪২৭০ কোটি টাকা। বিমা কোম্পানিগুলির থেকে পাওয়া
গেছে মাত্র ৭১৪ কোটি টাকা। কৃষি এখন লুটের জায়গা। প্রয়োজনে কড়া নীতি। যে সরকার
ক্ষমতায় আসে সেই সরকার কারও জন্য কড়া নীতি আর কারও জন্য নরমনীতি আনে। যেটা এতদিনে
স্পষ্ট। কৃষকের খুব বেশি আশা করার কিছু নেই, এই সরকারের কাছ
থেকে। বাজেট বরাদ্দ যাই হোক না কেন।
সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান কঠিন
হয়ে পড়েছে। এই বিষয়ের ওপর আক্রমণ নেমেছে ব্যাপকভাবে। ডিভিডেন্ট আয় কিছু বাড়ছে, মজুরি যদিও
ক্রমাগত চাপের মধ্যে থাকছে। কৃষকের সার -বীজ- সেচ বাজার নির্ভর। বাজার আবার এমনই
যে এমনকি বিমার টাকা চাইলে বিমা কোম্পানিগুলো টাকা আটকে বসে থাকে সেই কৃষকের যে ‘ইয়েস স্যার’, ‘নো ম্যাডাম’-এর
পাঠ নেয়নি। বাজেটে কতটা কী করবেন অরুণ জেটলি?
গণশক্তি, ৩১শে জানুয়ারি, ২০১৮
No comments:
Post a Comment