ড. অসীম দাশগুপ্ত
মোদী
সরকারের বাজেট পেশ হয়েছে সংসদে। এই বাজেট প্রস্তাবে জনগণের জন্য প্রতিশ্রুতির শেষ
নেই। কিন্তু বাস্তবের জমিতে বাজেট প্রস্তাবের সঙ্গে মিলবে কি এইসব প্রতিশ্রুতি? মূল আর্থিক সমস্যা সমাধানের কি
কোনও দিশা আছে এই বাজেটে? সেইসব
বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই দুটি লেখায়।
এই
কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করা হলো এমন একটি সময়ে যখন সমগ্র দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ
রয়েছেন গভীর উদ্বেগের মধ্যে। আর্থিক দিক থেকে উদ্বেগের মূল কারণগুলি হলো বেকারত্ব
এবং মূল্যবৃদ্ধি। দীর্ঘদিন
ধরে এই সমস্যাগুলি অপ্রশমিত থাকার কারণে স্বার্থান্বেষীমহল পরিস্থিতিকে ব্যবহার
করার চেষ্টা করে চলেছে, সাধারণ
মানুষের মধ্যেই ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে —
ধর্মের নামে এবং সরাসরি হিংস্রতা দিয়ে গণতন্ত্রের উপর
আক্রমণ করে — সর্বভারতীয়
স্তরে এবং এ রাজ্যের ক্ষেত্রেও।
এছাড়া, সাম্প্রতিককালে অতিরিক্ত আঘাত
এসেছে নোট বাতিলের পদক্ষেপের কারণে,
পণ্য পরিষেবা করের বিভ্রান্তিকর রূপায়ণের ফলে এবং
সর্বশেষে এফ আর ডি আই বিলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ব্যাঙ্কে রাখা সঞ্চয়ের ব্যাপক
ক্ষতির আশঙ্কায়।
১
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এই
বাজেটের অবস্থান
পূর্বেকার
তিনটি বছরে প্রতি বছরে কেন্দ্রীয় বাজেটে যে অতিরিক্ত দুকোটি কর্মসংস্থানের আশা
সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা
অর্জিত না হওয়ায় এবছরের বাজেটে সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা না রেখে, সেচের সম্প্রসারণ, বিপণনের পরিকাঠামোর উন্নয়ন
ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে এটা সতর্কতার লক্ষ্যনীয় যে, গ্রামাঞ্চলে পরিকাঠামো
নির্মাণে যেখানে জাতীয় কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে সেখানে এই খাতে
সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ বর্তমান বছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকার থেকে বৃদ্ধি না করে একই
অর্থাঙ্কে স্থির রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ১০ শতাংশ হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে প্রকৃত
অর্থে এই বরাদ্দ ১০ শতাংশ হ্রাস প্রাপ্ত হয়ে যাবে। এছাড়া প্রায় ৪,৮০০ কোটি টাকা গতবছর থেকেই
বকেয়া রয়ে গেছে।
এ
ছাড়া গ্রামাঞ্চলে কৃষির সঙ্গে সবজি ইত্যাদি চাষের গুরুত্ব দেওয়ার পর, এটা জানা সত্ত্বেও যে এর
প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সঙ্গে জমির সরাসরি যোগাযোগ
রয়েছে, এবং
তাই বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে ভূমিহীন, প্রান্তিক
এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থে ভূমিসংস্কারের ওপর। কিন্তু এই ভূমিসংস্কারের বিষয়ে
শ্রেণিস্বার্থের কারণে সম্পূর্ণভাবেই নীরব থেকেছে এই বাজেটের প্রস্তাবগুলি।
কেবলমাত্র জোর দেওয়া হয়েছে বাজার ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং পরিকাঠামোর উন্নতির
ওপর। এর ফলে এই উন্নতির সামগ্রিক সুযোগ এবং কর্মসংস্থানের সুবিধা থেকে বঞ্চিত
থাকবেন গরিব কৃষকরা। অথচ এদের স্বার্থে আয় বৃদ্ধি করার কথাই তো এই বাজেটের মাধ্যমে
প্রচার করার চেষ্টা হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্র ও অসংগঠিত শিল্পের গুরুত্বের কথা বলা
হলেও, এক্ষেত্রে
ঠিক কতটা কর্মসংস্থান হতে পারে তার কোনও লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়নি।
২
মূল্যবৃদ্ধি
মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের
ক্ষেত্রে মূল্যমানকে সাধারণ কৃষক এবং সাধারণ ক্রেতাদের স্বার্থে একটি স্তরে ধরে
রাখার জন্য উপযুক্ত ভরতুকির ভিত্তিতে গণবণ্টন ব্যবস্থা গুরুত্বের কথা অবশ্যই সকলের
জানা আছে। একথা জানা সত্ত্বেও এই বাজেটে তার লক্ষ্যে কোনও নির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা
বলা হলো না, এবং
সমস্ত বিষয়টি পুনরায় বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়া হলো এই বাজেটে। এবং এর
সমর্থনে কোনও যুক্তিই উল্লেখ করা হয়নি এই বাজেটে।
৩
রাজস্ব সংগ্রহ
এটা
লক্ষ্যণীয় যে, এই কেন্দ্রীয় বাজেটটি হলো পরিষেবা কর (জি এস টি)
লাগু করার পর প্রথম পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় বাজেট। যেহেতু জি এস টি লাগু করার
ক্ষেত্রে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটির যে সুপারিশ ছিল অপেক্ষাকৃত সরল
ব্যবস্থার, তা
মানা হয়নি এবং কর প্রদানের ক্ষেত্রেও থেকেছে জটিলতা, তাই কিভাবে এই কাঠামো আরও সরল করা যায় সাধারণ
ব্যবসায়ী, সাধারণ
ক্রেতা এবং রাজ্যগুলির স্বার্থে সেই বিষয়ে উল্লেখ করা অবশ্যই প্রয়োজন ছিল এই
বাজেটে। অথচ তা করা হলো না।
অন্যদিকে, নোট বাতিলের পর কালো টাকা
উদ্ধারের ক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত কি নির্দিষ্ট সাফল্য পাওয়া গেল এবং ভবিষ্যতে
এব্যাপারে কি চিন্তা করা হয়েছে তাও উল্লেখ করা হলো না।
৪
এফ আর ডি আই বিল
এফ আর
ডি আই বিলের মাধ্যমে অনাদায়ী ঋণ উদ্ধারের নাম করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে
সাধারণ মানুষের আমানতের উপর সমস্ত গ্যারান্টি তুলে দেওয়ার কথা বলে’, এই বিলটি শুধু সাধারণ সঞ্চয়ীদের
মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে তাই নয়। এর ফলে
সামগ্রিক ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা, এবং
আর্থিক ব্যবস্থার অস্থিরতার সৃষ্টি করার কারণ হয়েছে। এর ফলে শুরু হতে পারে সামগ্রিক
অর্থনীতিতেই নতুন এবং ব্যাপক মন্দার সংকট। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে
স্বচ্ছ মনোভাব ব্যক্ত করার সুযোগ ছিল এই বাজেটে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এই বাজেটে
এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য রাখতে পুনরায় ব্যর্থ হলো।
৫
রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে পুনরায়
আঘাত
এমনকি
লাভজনক ক্ষেত্রগুলিতেও পুনরায় জোর দেওয়া হলো বিলগ্নীকরণের। এবং এখানে
নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমাসংস্থাগুলির উপরও নামানো হলো নতুন ধরনের আঘাত।
একদিকে যেমন জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিমা সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে ঠিক তখনই এই
বিলগ্নীকরণ নতুন করে সংকটের কারণ সৃষ্টি হলো,
যার থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন পুনরায় সাধারণ মানুষই।
****
তাই
এই বাজেটে শুধু দেশের সাধারণ মানুষের মূল সমস্যাগুলি — বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, জি এস টি-র জটিলতা তা অপ্রশমিত
থাকছে তাই নয় — নতুন ধরনের আঘাত সাধারণ
মানুষের সঞ্চয় এবং বিমা ব্যবস্থার বিলগ্নীকরণের মাধ্যমে ব্যাপকতর সংকটের উৎস মুখ
খুলে দিচ্ছে। যেহেতু বাজেটের উপস্থাপনাটি আপাত দৃষ্টিতে মসৃণ, তাই আমাদের সতর্ক থাকার কারণও
জরুরি। এই ব্যাপারে এই বাজেটের মূল ক্ষতিকারক দিকগুলি সাধারণ মানুষের কাছে
ব্যাখ্যা করা উচিত এবং তার ভিত্তিতে অবশ্যই প্রয়োজন হবে ব্যাপকভাবে গণবিক্ষোভ ও
গণপ্রতিরোধের কর্মসূচির।
গণশক্তি,
২রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
No comments:
Post a Comment