20161017

‘‘মধ্যপথেই রুখে দিতে হবে ফ্যাসিস্তধর্মী শক্তির কর্মসূচি’’: সাক্ষাৎকারে বললেন সীতারাম ইয়েচুরি


ধর্মনিরপেক্ষতা-গণতন্ত্রের বিপদকে লড়াই করেই রুখে দিতে হবে
দেশে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপদ বাড়ছেসেই বিপদে মদত দিচ্ছে বি জে পির সরকার। ধর্মনিরপেক্ষতাগণতান্ত্রিক কাঠামো আক্রান্ত হচ্ছে। কেন্দ্রের সরকার খোলাখুলি ধনীদের স্বার্থে কাজ করছে। গণশক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বললেন সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। নয়াদিল্লিতে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গণশক্তির প্রতিনিধি।

১২ই সেপ্টেম্বর গত আড়াই বছরে আমরা যে ট্রেলারদেখেছি, তারপরে আর এস এস-র নেতৃত্বে পূর্ণ বিকশিত ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রের ভয়ংকর, অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদকে কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া যায় না। যে কোনো মূল্যে এই বিপদকে মধ্যপথেই বাধা দিতে হবে, প্রতিহত করতে হবে। সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এ কথা বলেছেন। সোমবার গণশক্তি-র সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইয়েচুরি বলেছেন, মেরুকরণকে তীব্র করার লক্ষ্যে সময়ে সময়ে নতুন বিষয় তোলা হচ্ছে। তথাকথিত লাভ জিহাদ, ঘর ওয়াপসি, জোর করে ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি। এখন চলছে গোরক্ষার নামে হাঙ্গামা। ঈদ-উল-জোহা উৎসবের প্রাক্কালে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করতে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। জঘন্য মনোবৃত্তির এই ধরনের নানা বাহিনী ক্রমেই সামনে আসতে থাকবে। বি জে পি সরকার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার বদলে মদতই দিচ্ছে।

ইয়েচুরি বলেছেন, মোদী সরকারের নীতি প্রকটভাবেই ধনীমুখী, কর্পোরেটমুখী, বিদেশি পুঁজির প্রতি পক্ষপাতমুখী। চলছে ধান্দার ধনতন্ত্রের দাপাদাপি। আড়াই বছরে আমাদের সংবিধানের চার স্তম্ভধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদুর্বল হয়েছে।

ইয়েচুরি বলেছেন, আর এস এস-র কর্মসূচি হলো ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র থেকে খোলাখুলি অসহিষ্ণু ফ্যাসিস্ত ধাঁচের হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। এই লক্ষ্য পূরণে আর এস এস ধারাবাহিকভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এস এস যদি সফল হয় তাহলে গুণগতভাবে পৃথক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। কিন্তু বামপন্থীদের দেখতে হবে যাতে ওই পরিস্থিতি বাস্তবায়িত না হয়। প্রস্তুতিপর্বেই মুখোমুখি, ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে রুখে দিতে হবে ওই বিপদের আশঙ্কাকে।

সাক্ষাৎকারের পূর্ণাঙ্গ বয়ান: 

গণশক্তি: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলি জয়ী হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এই পথেই কি লড়াই হবে

ইয়েচুরি: হ্যাঁ, খুবই তাৎপর্যপূর্ণ জয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ হচ্ছিল, এই প্রতিষ্ঠানের প্রগতিশীল চরিত্রের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। এই প্রেক্ষাপটে এই জয় খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। যদিও বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির ঐক্য আরো শক্তিশালী হতে পারত। এতদসত্ত্বেও জে এন ইউ-র ছাত্ররা আর এস এস-বি জে পির মতাদর্শগত কর্মসূচী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে জোরের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে, সঙ্ঘের ছাত্র সংগঠন এ বি ভি পি-কে কোণঠাসা করে দিয়েছে।

দেশের কথা যদি বলা যায়, সাম্প্রদায়িক বিপদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ে নিশ্চয়ই বামপন্থী ঐক্য প্রথম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারতের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য জে এন ইউ-র ছাত্রদের মতো নয়। সি পি আই (এম)-র ২১তম কংগ্রেসে বলা হয়েছিল, ভারতীয় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যকে বামপন্থীদের পক্ষে পরিবর্তন করতে হলে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের জোরই নির্ণায়ক উপাদান। মোদী সরকারের সার্বিক আক্রমণের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম গড়ে তুলেই এই ঐক্য অর্জন সম্ভব। সমস্ত জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপরে, দেশের ঐক্য-সংহতির ওপরে আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থীরা তেমন সমস্ত শক্তিকে সমবেত করার চেষ্টা করবে যারা এই পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। জনগণের সংগ্রামকে শক্তিশালী করেই বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে শক্তিশালী করা যাবে। 

গণশক্তি: কাশ্মীর জ্বলছে। সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের সফর, ফিরে এসে সর্বসম্মত প্রস্তাবের পরেও কাশ্মীর উপত্যকায় অশান্তি চলছেই। এই একটানা অশান্তি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন?

ইয়েচুরি: কাশ্মীরে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। কাশ্মীরী যুবকদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। অন্তত চার জেলায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের প্রস্তাবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে সমস্ত অংশেরসঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা শুরুর জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। এখনও তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হচ্ছে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরা খুব কঠিন। দুঃখজনক হলো সরকার এখনও কাশ্মীর সমস্যাকে দেখছে সীমান্তের ওপার থেকে পাকিস্তানের মদতপ্রাপ্ত এবং তাদের তৈরি করা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে। কাশ্মীরে পাকিস্তানের যোগাযোগ সকলেই জানে, ভারতের রাজনৈতিক মহলের সব অংশই তার নিন্দা করেছে, সরকারকে তা প্রতিহত করার জন্য বারংবার বলেওছে। কিন্তু সমস্ত অংশের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা ছাড়া কাশ্মীর সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

সি পি আই (এম) দুপথে চলার প্রস্তাব দিয়েছে। একদিকে, ভারতে সংশ্লিষ্ট সব অংশের সঙ্গে শর্তহীন ভাবে রাজনৈতিক আলোচনা শুরু করো। একই সঙ্গে আমরা বলেছি, আসন্ন সার্ক শীর্ষ বৈঠককে ভারত-পাক আলোচনা পুনরায় শুরুর জন্য প্রধানমন্ত্রী ব্যবহার করুন।

অন্যদিকে, আস্থাবর্ধক কিছু পদক্ষেপ এখনই ঘোষণা করা দরকার। যেমন, পেলেট বন্দুক ব্যবহার বন্ধ করা, যে সমস্ত পরিবারের সন্তানরা মারা গেছে তাদের এবং আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, নিরাপত্তা বাহিনীর তরফে অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগের অভিযোগের যথাযথ বিচার ও দোষীদের শাস্তি, অসামরিক এলাকা থেকে আফস্পা প্রত্যাহার করা, কাশ্মীরী যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের কর্মসূচি অবিলম্বে শুরু করা। এইভাবে দুপথেই যদি আন্তরিকভাবে এগোনো না যায় গোটা দেশকেই মূল্য দিতে হবে, ভারতের ঐক্য-সংহতির পক্ষে ক্ষতিকারক হবে।

গণশক্তি: কিন্তু সরকারের কোনো আগ্রহ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কেন?

ইয়েচুরি: সরকার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিচ্ছে না। তবে মনে হয়, আর এস এস-র রাজনৈতিক শাখা বি জে পি-র সরকার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করতেই আগ্রহী। আর এস এস-র মতাদর্শগত কর্মসূচি হলো ভারতকে অসহিষ্ণু ফ্যাসিস্ত-ধাঁচের হিন্দু রাষ্ট্রেরূপান্তরিত করা। বি জে পি সরকার তাকেই এগিয়ে নিতে চায়। তাছাড়া, সামনেই উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। বি জে পি হয়তো ভাবছে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ যত বেশি হবে উত্তর প্রদেশ এবং দেশের অন্যত্র তত বেশি নির্বাচনী ফায়দা তুলতে পারবে বি জে পি।

গণশক্তি: বি জে পি সরকার আর কী কী ভাবে আর এস এস-র মতাদর্শগত কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজ করছে?

ইয়েচুরি: নানা ভাবে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করার লক্ষ্যে সময়ে সময়ে নতুন বিষয় তোলা হচ্ছে। তথাকথিত লাভ জিহাদ, ঘর ওয়াপসি, জোর করে ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি। এখন চলছে গোরক্ষার নামে হাঙ্গামা। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে গোরক্ষক সমিতি বানানো হয়েছে, এই ঝটিকা বাহিনী গোরু রক্ষা এবং আইন প্রয়োগ করছে বলে নিজেরা দাবি করছে। নির্বিচারে সংখ্যালঘু এবং দলিতদের ভয় দেখানো হচ্ছে। গোহত্যার মিথ্যা অভিযোগ তুলে মহম্মদ আখলাক, বা ঝাড়খণ্ডের লাতেহারে দুই যুবককে খুন করা হয়েছে। গুজরাটের উনায় দলিতদের ওপরে নৃশংস আক্রমণ হয়েছে। পরপর এই আক্রমণের সর্বশেষটি ঘটেছে হরিয়ানার মেওয়াটে। মুসলিম-নিবিড় এই জেলায় গোমাংস রাখার অভিযোগ তুলে দুই তরুণীকে দলবদ্ধ ভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে, এক দম্পতি খুন হয়েছেন। গোমাংস আছে কিনা তা তল্লাশি করতেবিরিয়ানির নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। ঈদ-উল-জোহা, যা সাধারণভাবে বকরি-ঈদ বলে পরিচিত সেখানে চিরাচরিত খাদ্যই হলো বিরিয়ানি। ঠিক এই উৎসবের প্রাক্কালে গোটা সম্প্রদায়কে সন্ত্রস্ত করে তোলা চলতি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পদ্ধতি।

এই গোরক্ষক বাহিনীর সন্ত্রাসের কায়দার সঙ্গে জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ত ঝটিকা বাহিনীর কায়দার মিল শিউরে ওঠার মতোই।

অনেক বি জে পি রাজ্য সরকার বা অন্য রাজ্য সরকার গোরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। তা প্রয়োগের দায়িত্ব রাজ্যের আইনরক্ষকদের। স্বঘোষিত পাহারাদাররা এ কাজ করতে পারে না। সরকারি মদতপ্রাপ্ত এইসব গোরক্ষক বাহিনীকে অবিলম্বে আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

পোশাক, আচরণ ইত্যাদি নিয়ে মহিলাদের ভয় দেখিয়ে বেড়ানো বাহিনী আমরা দেখেছি। জঘন্য মনোবৃত্তির এই ধরনের নানা বাহিনী ক্রমেই সামনে আসতে থাকবে। বি জে পি সরকার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার বদলে মদতই দিচ্ছে।

গণশক্তি: নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনে জিতেছিলেন আচ্ছে দিন’, পাঁচ বছরে ১০কোটি কর্মসংস্থানের মতো স্লোগান দিয়ে। মুখে সংস্কারের কথাও তো বলা হচ্ছে। তাহলে এই ধরনের ঘটনা দেশে ঘটছে কেন?

ইয়েচুরি: অর্থনৈতিক বোঝার ভারে ধুঁকতে থাকা জনগণের মধ্যে মিথ্যা আশার জাল বুনে নির্বাচনী সমর্থন লাভের লক্ষ্যে ওই স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। প্রতিশ্রুতির ওইটুকুই অর্থ।

দ্বিতীয়ত, এই সরকারের নীতি প্রকট ভাবেই ধনী-মুখী, কর্পোরেট-মুখী, বিদেশি পুঁজির প্রতি পক্ষপাত-মুখী। এই সরকার জনমুখী বা দরিদ্র মানুষের স্বার্থে নীতি রূপায়ণ করতে অন্তর্নিহিত ভাবেই অক্ষম। এখন আমরা দেখছি ধান্দার ধনতন্ত্রের দাপাদাপি। কর্পোরেট ও ধনীরা কার্যত সম্পদ লুটের মহোৎসব করছে। গত দুবছরেই প্রতি বছর ৫.৫লক্ষ কোটি টাকা কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, কর্পোরেট ঋণখেলাপিদের ১.১২লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মকুব করা হয়েছে। অথচ যে ভারতীয় কৃষকরা কয়েক হাজার টাকার ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন তাঁদের ঋণ মকুব করা হচ্ছে না, তাঁদের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করা হচ্ছে না। আমরা দেখছি শিল্পে মন্দা, ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে অবনতি, ২০১৫-তে মাত্র ১.৩৫লক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ( যদিও বছরে প্রয়োজন ১.৩কোটি এবং প্রতিশ্রুতির বহর হলো ২কোটি), রেগা, গণবণ্টনের মতো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে বিপুল ছাঁটাই। এক কথায় ধনীদের আরো সম্পদবৃদ্ধি, গরিবরা আরো দরিদ্র হচ্ছেন।

এইসব বাস্তবতা আড়াল করতে তথ্যে কারচুপি হচ্ছে, অর্থনৈতিক বিকাশের উঁচু হার দেখানোর চেষ্টা চলছে। সর্বশেষ ঘটনা হলো দারিদ্র্যকে পুরো উধাও করে দেওয়া হবে! প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের নীতি আয়োগ বলছে ভারতে দারিদ্র্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতেই তারা অক্ষম!

গণশক্তি: নরেন্দ্র মোদীর সরকার মেয়াদের প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে এসেছেআপনার মূল্যায়ন কী?

ইয়েচুরি: এই আড়াই বছরে মোদী সরকার দেশে খুব উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে যা আমাদের সাধারণতন্ত্রের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে। সংক্ষেপে বললে এই সরকারের চার মুখএক, আর এস এস-র কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি। দুই, জনবিরোধী অর্থনৈতিক নীতি যা দুই ভারতের ব্যবধানকে আরো চওড়া করছে, পুরোপুরি আন্তর্জাতিক ও দেশিয় কর্পোরেট ও বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে কাজ করছে। তিন, ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী প্রবণতা যা প্রতিফলিত হয়েছে অরুণাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়া বা সংসদীয় রীতিনীতি সহ সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে খর্ব করার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে। চার, ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব রণনীতি, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের ছোট শরিকে পরিণত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি ওবামার সর্বশেষ যৌথ বিবৃতিতে যা স্পষ্টভাবেই উচ্চারিত হয়েছে।

এই আড়াই বছরে আমাদের সংবিধানের চার স্তম্ভধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদুর্বল হয়েছে।

গণশক্তি: অতীতে ৬ বছর বি জে পি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার দেখেছি আমরা। এই বি জে পি সরকার সেই সরকারগুলি থেকে কীভাবে পৃথক?

ইয়েচুরি: হ্যাঁ, বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে বি জে পি-নেতৃত্বাধীন এন ডি এ কোয়ালিশন সরকার ছিলো ১৯৯৮-২০০৪পর্বে। কিন্তু এই দুই সরকারের মধ্যে গুরুতর পার্থক্য রয়েছে। তখন বি জে পি-র একক গরিষ্ঠতা ছিলো না, কোয়ালিশন সরকার চলছিল, ‘কোয়ালিশনের বাধ্যবাধকতায়বি জে পি কট্টর হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাকে তাকে তুলে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০নং ধারা বাতিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে পিছনে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। মোদী সরকারের ক্ষেত্রে বি জে পি-র লোকসভায় গরিষ্ঠতা আছে। সুতরাং তারা আর এস এস-র ফ্যাসিস্তধর্মী কর্মসূচি খোলাখুলি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আর এস এস-র ফ্যাসিস্তধর্মী কর্মসূচি সম্পর্কে সি পি আই (এম)-র সময়োপযোগী কর্মসূচিতে বলা হয়েছে: ‘‘সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ত ধাঁচের আর এস এস পরিচালিত জোটের শক্তিবৃদ্ধি ও কেন্দ্রে তাদের ক্ষমতা দখলের ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তির বিপদ গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে’’ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থা এবং জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে এই প্রবণতার বিপদের কথা বলতে গিয়ে কর্মসূচিতে বলা হয়েছে: ‘‘ বি জে পি ও তাদের সাম্প্রদায়িক মঞ্চের প্রতি বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণির কোনো কোনো অংশের সমর্থন দেশের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে গুরুতর বিপদের আশঙ্কা তৈরি করেছে’‘(পরিচ্ছেদ ৫.৭)

কর্মসূচিতে আরো বলা হয়েছে, ‘‘ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উপর ভর করে যে ফ্যাসিস্ত প্রবণতা বিস্তার লাভ করছে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই সর্বস্তরে দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই চালাতে হবে’’(পরিচ্ছেদ ৫.৮)।

পার্টি কর্মসূচিতে বলা হয়েছে, ‘‘ বিভেদকামী ও সাম্প্রদায়িক মঞ্চের ভারতীয় জনতা পার্টি একটি প্রতিক্রিয়াশীল দল। তাদের প্রতিক্রিয়াশীল মর্মবস্তুর ভিত্তি হলো অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী জাত্যাভিমান। বি জে পি কোনো সাধারণ বুর্জোয়া দল নয় কেননা ফ্যাসিস্ত ধাঁচের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তাদের পরিচালনা করে, আধিপত্য করে। বি জে পি ক্ষমতায় আসায় রাষ্ট্রক্ষমতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সংস্থায় প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে আর এস এস। হিন্দুত্ব মতাদর্শ পুনরুত্থানবাদকে মদত দেয়, হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতের মিশ্র সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে... সেইসঙ্গে বৃহৎ বাণিজ্য ও জমিদারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদ বি জে পি-কে সর্বাত্মক সমর্থন দিচ্ছে’’ (পরিচ্ছেদ ৭.১৪)।

এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই আদবানির কুখ্যাত রথযাত্রার সময় থেকে আমি বলে থাকি, লিখেও থাকি যে আর এস এস-র কর্মসূচি হলো ভারতকে সাংবিধানিক ভাবে ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র থেকে খোলাখুলি অসহিষ্ণু ফ্যাসিস্ত ধাঁচের হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। এই লক্ষ্য পূরণে আর এস এস দৃঢ়ভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতির বিচার করে এ বছরের জুনে ত্রিচূড়ে ই এম এস স্মৃতির উদ্বোধনী ভাষণে আমি বলেছিলাম, ‘‘ আর এস এস যদি সফল হয় তাহলে গুণগত ভাবে পৃথক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। বিপ্লবী শক্তিকে দেখতে হবে যাতে ওই পরিস্থিতি বাস্তবায়িত না হয়।’’ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে তাঁর রিপোর্টে জর্জি ডিমিট্রভ বলেছিলেন, ‘‘ ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে বুর্জোয়া সরকারগুলি অনেকগুলি প্রাথমিক স্তরের মধ্যে দিয়ে যায়, অনেকগুলি প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা চালু করে যা ফ্যাসিবাদকে সরাসরি ক্ষমতা দখলে সাহায্য করে। এই প্রস্তুতির স্তরে বুর্জোয়াদের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাগুলির বিরুদ্ধে এবং ফ্যাসিবাদের বিকাশের মোকাবিলায় যারা লড়াই চালায় না তারা ফ্যাসিবাদের বিজয় অর্জন প্রতিহত করার অবস্থায় থাকে না, বরং বিপরীতে সেই বিজয়কেই সাহায্য করে’’

মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মতো কেন্দ্র কিছু শক্তিকে পেয়েছে যারা পরোক্ষ ভাবে আর এস এস-র সঙ্গেই চলে, পরিকল্পনামাফিক গণতান্ত্রিক শক্তিকে দুর্বল করতে তৎপর। আজকের প্রকৃত বাস্তবতার জমিতে পা রেখে চলা যে কোনো সচেতন মানুষই দেখতে পাবেন কোন অভিমুখে ভারত চলেছে যদি না এই বিপদকে মুখোমুখি এবং ঐক্যবদ্ধ ভাবে মোকাবিলা করা যায়। যদি আমরা এই আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে না লড়াই চালাই ১৯৫০-র পর থেকে ভারতের যেটুকু অগ্রগতি ঘটেছে তা-ও খর্ব হবে। গত আড়াই বছরে আমরা যে ট্রেলারদেখেছি, তার পরে আর এস এস-র নেতৃত্বে পূর্ণ বিকশিত ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রের ভয়ংকর, অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদকে কোনো ভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া যায় না। যে কোনো মূল্যে এই বিপদকে মধ্যপথেই বাধা দিতে হবে, প্রতিহত করতে হবে। এই বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের অঙ্গীকার, আমাদের প্রতিজ্ঞা।

গণশক্তি, ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬

No comments:

Post a Comment