20161017

অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে আমাদের পার্টিই

ডা: সূর্যকান্ত মিশ্র

গত এক বছরের মধ্যে দুনিয়া, দেশ ও রাজ্যের পরিস্থিতিতে অনেক নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে একটা সাধারণ ও অতি বিপজ্জনক প্রবণতা হলো এই তিন ক্ষেত্রেই দক্ষিণপন্থার উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্ব পুঁজিবাদী সঙ্কটের আট বছর পরেও সেই সঙ্কট থেকে উদ্ধারের কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। বরং দেখা যাচ্ছে, বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকের মহামন্দা থেকে এবারের মন্দা পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সেই মন্দা পরিস্থিতি চার বছর ধরে চলেছিল। এবার আট বছর পরেও সেই লক্ষ্মণ তো দেখাই যাচ্ছে না, উলটে আবার নতুন করে আরেকটা মন্দার সম্ভাবনাই প্রবলতর হচ্ছে। খোদ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ (আমাদের দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো) সহ সভাপতি স্ট্যানলি ফিসার সেখানকার অর্থনীতির হার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, ১৯৭৯ সালের পরে অর্থনীতিতে এটাই সবচেয়ে খারাপ সময়। গত তিন মাসেই উৎপাদনের সবচেয়ে খারাপ রেকর্ড দেখা যাচ্ছে। ১৯৪৯ সাল থেকে ২০০৫ সালের তুলনায় ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের সময়কালে উৎপাদনশীলতার হার ১.২৫ শতাংশ কমেছে। তাঁর মতে, যদি এমন চলতে থাকে তাহলে কর্মসংস্থান এবং প্রকৃত মজুরির ওপরে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে। বিনিয়োগ কমছে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের গতি শ্লথ হয়েছে, সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই ঋণের বোঝা বিপুল পরিমানে বাড়ছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট সিলার মনে করেন, বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত, তাঁরা আস্থা হারাচ্ছেন। কারণ ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ, অভিবাসন, সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষাপট।

আসলে সিলার যা বলেননি তা হলো, তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের মদতে। আর অভিবাসন ও শরণার্থী সমস্যা তার থেকেই। আবার তার বিরুদ্ধেই পালটা মাথা চাড়া দিচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বর্গরাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির বিরুদ্ধে জাতীয় পুঁজি আস্ফালন দেখাচ্ছে। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট। তাই সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যেকার যে দ্বন্দ্ব প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছিল সেটা আবার মাথা তুলতে শুরু করেছে।

অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে মহামন্দার পরে যেরকম আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী বা সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, ফ্যাসিবাদের উত্থান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল, এখনও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার এবং বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাবে, ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সালের সময়কালের তুলনায় বিশ্বের মোট উৎপাদন (ওয়ার্ল্ড জি ডি পি) বৃদ্ধির হার ২০০৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান। এর পাশাপাশি দুনিয়াজুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থী, নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তির বৃদ্ধি ঘটছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যত কমছে দুনিয়াজুড়ে এদের দাপাদাপি তত বাড়ছে। দুবছর আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত সাংসদদের মধ্যে এক চতুর্থাংশই ছিল এইসব নিও ফ্যাসিস্ত বা চরম দক্ষিণপন্থী শিবিরের। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এই প্রথম ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন উগ্র জাতীয়তাবাদীর কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। লাতিন আমেরিকায় ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এমনকি বলিভিয়ায় উগ্র দক্ষিণপন্থীদের দাপাদাপি দেখা যাচ্ছে গত একবছর ধরে। আফ্রিকার দক্ষিণ থেকে উত্তরে, তুরস্ক থেকে ভারতে সর্বত্র দক্ষিণপন্থীদের আস্ফালন দেখা যাচ্ছে।

********
আমাদের দেশে দ্বিতীয় এন ডি এ সরকারের দুবছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই যে এই সরকার বাজপেয়ী আদবানীদের প্রথম এন ডি এ সরকারের থেকে অনেক বেশি দক্ষিণপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল, উগ্র হিন্দুত্ববাদী, সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা, একনায়কতন্ত্রী। ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীসুলভ উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি সংঘ পরিবারের নিয়ন্ত্রণ এই সরকারের ওপরে অনেক বেশি। বি জে পি এককভাবেই এবার লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিপদ এখন অনেক বেশি।

বলা হচ্ছে, এবছর নাকি ভারত বৃদ্ধির হারে সারা বিশ্বে প্রথম স্থানে থাকবে। অথচ আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো, বৃদ্ধি বলতে মূল্যবৃদ্ধি, বৃদ্ধি বেকারীর, শিল্পে মন্দার, কৃষিতে সঙ্কটের। সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসী, মহিলাদের নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ধনী গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব, স্বাধীন বৈদেশিক নীতি ও অখণ্ডতার সামনে বিপদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বিপন্ন করে এককেন্দ্রীকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জটিলতা কেমন বাড়ছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো কাশ্মীর। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কাশ্মীর সমস্যা এত জটিল আগে কখনো হয়নি। ভারত ও ভারতবাসীর সুরক্ষার চাইতে তথাকথিত গোরক্ষাই গেরুয়াবাহিনীর এখনকার প্রধান কর্তব্য। নাথুরাম গডসের অনুগামীরা এখন দেশপ্রেমিক সেজেছে। ইতিহাস, পাঠ্যসূচী বিকৃত করা হচ্ছে। হিন্দি, হিন্দুত্ব ও হিন্দিস্তানের স্টিমরোলার দিয়ে এরা বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চর্চা, যুক্তিবাদ ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কাঠামোটাকে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। এক কথায় স্বাধীনতার পরে দেশজুড়ে সমস্ত ক্ষেত্রব্যাপী সঙ্কটের বৃদ্ধি দেশকে এক ভয়াবহ বিপদের সামনে দাঁড় করিয়েছে।

********
আমাদের রাজ্যে তৃণমূল সরকারের দ্বিতীয়বারের মেয়াদ চলছে। দ্বিতীয় তৃণমূল সরকার শুরু থেকেই আরও উগ্র ফ্যাসিবাদী কায়দায় চলছে। বছর শেষ হওয়ার আগেই রাজ্যকে বিরোধীশূণ্য করার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে শাসকদল। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণ, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপদ, জীবনজীবিকার ওপরে আক্রমণ এসবই এরাজ্যে তীব্রতর হচ্ছে। একদিকে বি জে পি চায় কংগ্রেসমুক্ত ভারতআর এখানে তৃণমূল চায় বিরোধীশূণ্য পশ্চিমবঙ্গ। আসলে উভয়েরই মূল লক্ষ্য বামপন্থীরা। পশ্চিমবঙ্গ এখনো বামপন্থীদের সবথেকে বড় ভিত্তি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যার বিচারেও দেশের বাকি অংশে বামপন্থীদের যা ভোট তার যোগফলের তুলনায় এরাজ্যের বামফ্রন্টের ভোট বেশি। এরাজ্যে সি পি আই (এম)-ই বামপন্থীদের প্রধান শক্তি, তাই স্বাভাবিক কারণে তাদের ওপরেই আক্রমণ নেমে এসেছে সর্বাপেক্ষা তীব্রভাবে। বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের শক্তি দুর্বল হলে সারা দেশে বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি দুর্বল হবে। তাই সাম্রাজ্যবাদ, কেন্দ্র এবং রাজ্যে ক্ষমতাসীন শাসকদল বামপন্থীদের ওপরে আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করার প্রশ্নে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে হাত ধরাধরি করে। বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির আক্রমণ ও উদারনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বামপন্থীরাই প্রথম সারিতে রয়েছে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনে বামপন্থীরা শুধু সামনের সারিতেই আছে তাই নয়, মতাদর্শগত বিচারে এই লড়াইয়ের একমাত্র নির্ভরযোগ্য শক্তি। শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন জীবিকার সংগ্রামের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই সমস্ত প্রশ্নেই এরাজ্যে বামপন্থীদের সংগ্রাম কেবলমাত্র এরাজ্যের মানুষের স্বার্থরক্ষার মধ্যেই সীমিত নেই, তার চেয়েও বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রসারিত। সমগ্র ভারতীয় জনগণের মতাদর্শ ও রাজনৈতিক সংগ্রাম ক্ষমতা এর ওপরে নির্ভরশীল। এর বিপরীতে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদসহ দেশ ও রাজ্যের শাসকদলের স্বার্থ। এই দুই স্বার্থের সংঘাতের কেন্দ্র বিন্দু হলো আজকের পশ্চিমবঙ্গ।

দুনিয়া দেশ ও রাজ্যে দ্রুততার সাথে দক্ষিণপন্থা যে আগ্রাসী ভূমিকায় অগ্রসর হচ্ছে তাতে কেবল বামপন্থীদের পক্ষে এককভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব একথা মনে করা সংকীর্ণতাবাদ ও হঠকারিতার শামিল হবে। আবার ব্যাপক মঞ্চ গঠনের নামে বাম ও গণতান্ত্রিক বিকল্পের জন্য পার্টির স্বাধীন উদ্যোগ গ্রহণের কাজ অবহেলা করা দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ ছাড়া কিছু নয়। রাজ্য ও দেশব্যাপী সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে ব্যাপকতম প্রতিরোধের মঞ্চে সমবেত করেই এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। বামপন্থীদের নিজস্ব উদ্যোগে সংগ্রাম ও সংগঠনকে শক্তিশালী না করে এই মঞ্চ গড়ে তোলা অসম্ভব। এসব প্রশ্নে কেবল কৌশল নিয়ে বিতর্কে অযথা সময় অপচয় না করে ময়দানে নেমে সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে লাইনের সঠিকতা যাচাই করাই হলো একমাত্র পথ। সেই জন্য আমাদের পার্টির রাজ্য কমিটি আহবান জানিয়েছেপ্রথমত, সি পি আই (এম)-র নিজস্ব উদ্যোগে শ্রেণি সংগ্রাম ও গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, বামফ্রন্টের সম্মিলিত সংগ্রামকে বিকশিত করতে হবে। তৃতীয়ত, বামফ্রন্ট বহির্ভুত বামপন্থী ও বাম সহযোগী দলগুলিকে নিয়ে যুক্ত সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। এবং চতুর্থত, রাজ্যে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপরে আক্রমণ মোকাবিলায় কংগ্রেস ও সব বাম ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে নিয়ে ব্যপকতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রাজ্যের আন্দোলন সংগ্রামের প্রধান ইস্যুগুলি চিহ্নিত করা দরকার। প্রথমত, গণতন্ত্রের ওপরে ফ্যাসিবাদী কায়দায় আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে। ২১১টা আসনে জয়লাভ করেও পুলিশ, প্রশাসন, অর্থবল, পেশীবলের এমন ব্যাপক ব্যবহার করে বিরোধীদের বিধায়ক পদ, পঞ্চায়েত, পৌরসভা দখলের দৃষ্টান্ত পশ্চিমবঙ্গ আগে কখনো দেখেনি। শাসকদল ঘোষণা করে দিয়েছে, এই বছরের মধ্যেই সি পি আই (এম) এবং কংগ্রেসমুক্ত করা হবে পশ্চিমবঙ্গকে। বামপন্থীদের মতাদর্শ, সংগ্রাম ও সংগঠনের দুর্বলতাকে অস্বীকার না করেও একথা বলা যায় যে আসলে এটা শাসকদলেরই দুর্বলতা ও ভীতির প্রতিফলন। ২১১টা আসনে জিতেও আত্মবিশ্বাসের এত অভাব! এর প্রধান কারণ হলো, মানুষের ওপরে আস্থার অভাব। মুখ্যমন্ত্রী মানুষকে ভয় পাচ্ছেন, কারণ তিনি জানেন যে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের ভিত্তিতে তাঁর এই জয় আসেনি। ২কোটি ১৫লক্ষ মানুষ যে তৃণমূল ও বি জে পি-র বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন সেটাই তাঁর মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শতাংশের হারের বিচারে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৫শতাংশের কিছু বেশি, আর সংখ্যার বিচারে ৩০লক্ষের মতো বেশি। কোনো সন্দেহ নেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হঠাৎ করে গড়ে ওঠা বিরোধী জোট নিয়ে অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তি ছিল, তার সঙ্গে ছিল অপরপক্ষের ভোট লুটের কৌশল। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক বুথ বেছে নিয়ে বিপুল অর্থ ও পেশীবল ব্যবহারের মাধ্যমে ভোট লুটের নিখুঁত পরিকল্পনা সত্ত্বেও বিরোধীদের সঙ্গে মাত্র ৩০লক্ষের ব্যবধান মুখ্যমন্ত্রীর ভয়ের প্রধান কারণ। তিনি বিলক্ষণ বোঝেন, শতকরা ৩ভাগ ভোট এদিক ওদিক হলে ফলাফলটাও বিপরীত হয়ে যেতে পারতো। বি জে পি-র সঙ্গে গোপন বোঝাপড়াটাও চিরকাল যে গোপন থাকবে না সেই আশঙ্কাও তাঁর রয়েছে। সর্বোপরি কৃষকের আত্মহত্যা, শ্রমিকের অনাহারে মৃত্যু, কারখানার পর কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শিল্পের মড়ক, টেট-এস এস সি-পি এস সি কেলেঙ্কারি, সারদানারদা কেলেঙ্কারি, সিন্ডিকেট আর তোলাবাজি, দুর্দমনীয় দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্যে নারী শিশু-সহ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, এমনকি শাসকদলের অনুগামীদের মধ্যেও গোষ্ঠী সংঘর্ষ বৃদ্ধি-সহ জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। রাজ্যের ঋণের বোঝা পূর্বাপেক্ষা অনেক দ্রুতহারে বাড়ছে। ২টাকা কেজি দরের চালের পরিমাণ ও গুণমানে অবনতি ঘটছে। এছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর নিজের দেওয়া অঢেল প্রতিশ্রুতির বন্যাই এখন তাঁর রাজত্বকে ভাসিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। নির্মাণকারী ঠিকাদারদের টাকা পাইয়ে দেওয়ার পরে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, কিষাণ মান্ডির কাঠামোগুলি এখন ভগ্নস্তুপের মতো পড়ে রয়েছে। কিছু ঠিকাদার আবার তোলা দিয়েছেন, কিন্তু প্রাপ্য টাকার সবটা পাননি। ৫বছরের উন্নয়নের কঙ্কালসার চেহারাটা বেরিয়ে পড়ছে। সিঙ্গুরে বিজয়োৎসব আসলে মুখ্যমন্ত্রীর নার্ভাস প্রতিক্রিয়া। নির্বাচনের জয় যে জনগণের মধ্যে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসের রূপ নিতে পারেনি সেটাই তাঁর নার্ভাস হয়ে পড়ার প্রধান কারণতাই বেপরোয়া আক্রমণ। মুখ্যমন্ত্রী জানেন, নির্বাচিত বিধায়কদের কিংবা পঞ্চায়েত পৌরসভা যেনতেন প্রকারে দখল করলেও মানুষের মনের দখল তিনি নিতে পারবেন না। নির্বাচনের আগেই মানুষের মধ্যে যে মোহমুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা কিছুদিনের মধ্যে আরো তীব্র হতে বাধ্য।

রাজ্যে বি জে পি-র হাল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জরাজীর্ণ। কেন্দ্রের হাত এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মাথায় রয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেন্দ্রের নীতিগুলির বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়ছে। ২রা সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটই তার প্রমাণ। কিন্তু আর এস এস-এর ফ্যাসিস্তসুলভ উগ্র হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপের প্রসার বা বৃদ্ধিকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। জনবিচ্ছিন্নতার বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য কেন্দ্রের শাসকদলের প্রধান হাতিয়ার এই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি। সারা দেশের মতো আমাদের রাজ্যেও এটা গুরুতর বিপদ। আর এস এস-এর এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিপরীতের সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক শক্তিকেও জমি জোগাতে সাহায্য করছে। সীমান্তবর্তী রাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে আমাদের এই বিপদও অনেক বেশি। কিন্তু এটা বোঝা দরকার তৃণমূলকে পরাস্ত না করে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ রক্ষা করা অসম্ভব। রাজ্যে তৃণমূল সরকারের এই সুবিধাবাদী অবস্থানই উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির বাড়বাড়ন্ত ডেকে এনেছে।

********
বামপন্থীদের সামনে রাজ্যে আন্দোলন সংগ্রামের ইস্যু অনেক। কিন্তু এগুলিকে নিয়ে যে ব্যাপক ভিত্তিক গণসংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব তা করা যায়নি। এর কারণগুলি চিহ্নিত করে পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দুর্বলতাগুলি কাটিয়ে উঠতে হবে। এখানে প্রধান দুটি দুর্বলতার উল্লেখ করা হচ্ছে।

প্রথমত, স্থানীয় আশু আদায়যোগ্য দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে পঞ্চায়েত পৌরসভা গ্রাম শহর কলকারখানা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সামাজিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলায় আমাদের উদ্যোগ অপর্যাপ্ত। বিশেষত কেবল সরকার বিরোধিতা নয়, সরকারী প্রকল্পগুলির রূপায়ণে ঘোষণা ও বাস্তবের মধ্যে ফারাক, দুর্নীতি, দলবাজি, ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি পার্টি ও গণফ্রন্টের মাধ্যমে রক্তদান, সাক্ষরতা, কোচিং, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, কৃষিবিকাশ, সমবায়, শিশুকিশোর সংগঠন, ক্লাব, খেলাধুলা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানমেলা, ইত্যাদি বহুমাত্রিক ইতিবাচক কর্মসূচী নিতে হবে। এসব না করে রাজ্যের দাবিগুলি নিয়ে বড় বড় কেন্দ্রীয় সমাবেশ সব সময় পরিস্থিতির চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। এই সংগ্রামগুলিকে স্বতঃস্ফূর্ততার ওপরে ছেড়ে না দিয়ে তাকে সংগঠিত করা ও এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া এখন সব চাইতে জরুরী কাজ। শুরুতেই এলাকা ও আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা দরকার। অগ্রাধিকার ভিত্তিক পরিকল্পনা ছাড়া কিছু বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাতের শক্তি অর্জন করতে পারবে না। অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে শ্রমিক কৃষক খেতমজুরসহ এলাকার নানা রকমের মানুষের শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে তোলার পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে মহিলা, সংখ্যালঘু, তফসিলি ও আদিবাসী মানুষের, অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের বিশেষ করে পশ্চাদ্‌পদ অংশের দাবিগুলিকে নিয়ে সংগ্রামকে যুক্ত করতে হবে। সর্বত্রই অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মকে সামনের সারিতে নিয়ে আসতে হবে।

দ্বিতীয়ত, রাজ্যের জ্বলন্ত ইস্যুগুলি নিয়ে রাজ্য বা জেলাগত আন্দোলনের কর্মসূচী অবশ্যই সংগঠিত করতে হবে। কিন্তু তার পূর্বশর্ত হিসাবে স্থানীয়স্তরে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ দাবিগুলির ভিত্তিতে ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয় না। অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন মঞ্চ থেকে রাজ্যব্যাপী আন্দোলনের কর্মসূচীর ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু প্রায়শই এগুলি এত উপর্যুপরি বা একটার ওপরে একটা চেপে বসে যে ঠাসা কর্মসূচীর ভিড়ে স্থানীয় সংগ্রামগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা সুনিশ্চিত করার বিষয়টি। কাজেই, রাজ্যভিত্তিক ও স্থানীয় মূলত এই দুই ধরনের সংগ্রামের মধ্যে পারস্পরিক ভারসাম্য ও সমন্বয় বজায় রাখার দুর্বলতাগুলি দূর করতেই হবে। এর মধ্য দিয়েই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলি নিয়ে সংগ্রামকে রাজনৈতিক সংগ্রামে উন্নীত করতে হবে।

স্বতঃস্ফূর্ততার ওপরে নির্ভর না করে সংগঠিত সংগ্রাম গড়ে তোলার অত্যাবশ্যক শর্ত হচ্ছে সংগঠন। সাংগঠনিক দুর্বলতাই আমাদের প্রধান দুর্বলতা। এখানে সংগঠন বলতে মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠনের বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি সংগঠনের কথাই বলা হচ্ছে, যা এই চার ফ্রন্টেই সংগ্রাম পরিচালনা করতে পারবে। কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠন সংক্রান্ত প্লেনাম সেরকম একটি গণলাইন নির্ভর বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছে। রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সেই নির্দেশগুলি কার্যকরী করার জন্য রাজ্যের সংগঠন সংক্রান্ত প্লেনাম হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্লেনামের মূল আহবান ছিল পার্টির দৈনন্দিন কাজে রুটিন সর্বস্ব গতানুগতিকতা বর্জন করে নিরন্তর ও নিবিড় গণসংযোগ গড়ে তোলা। জনগণের কাছে যেতে হবে, তাঁদের কাছে মতাদর্শ, রাজনীতি ও সংগ্রামের কথা নিয়ে যেতে হবে। আবার তাঁদের কাছ থেকে এসব বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা নিয়ে আসতে হবে। এগুলির পর্যালোচনার ভিত্তিতে আমাদের চার রকমের সংগ্রামেরই পরীক্ষা করতে হবে প্রয়োগের মাপকাঠিতে। এরমাধ্যমে আমাদের ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করতে হবে, সংশোধন করতে হবে এবং সংশোধন করে তা নিয়ে ফের জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণের মধ্যে এই নিরন্তর যাওয়া আসা দেওয়া নেওয়ার মধ্য দিয়েই আমাদের সংগঠন অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত ও শক্তিশালী হতে পারে। ত্রুটি সংশোধনের লক্ষ্যে পার্টির বিপ্লবী চরিত্রের অবক্ষয়গুলি চিহ্নিত করে দূর করতে হবে। আমাদের রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন ৩৪বছরে একটা অনুকূল পরিস্থিতিতে সংগঠনের যে প্রসার ঘটেছিল বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তা সংহত করা পার্টির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। আমাদের কাজের মুখ্য অভিমুখ হতে হবে পরিস্থিতির উপযোগী নতুন কাজের ধারা আয়ত্ব করা, সংগ্রাম সংগঠনের পুণর্বিন্যাস করা, নিষ্ক্রিয় সদস্যদের চাপ থেকে সংগঠনকে মুক্ত করে শ্রেণি সামাজিক ও বয়সের গঠনের পরিবর্তনের জন্য নতুন নতুন অংশকে সংগঠনে নিয়ে আসা, কমিটিগুলির সংখ্যা ও স্তরের বাহুল্য কমিয়ে এবং একই বিষয় নিয়ে দীর্ঘ নিষ্ফলা আলোচনা কমিয়ে কমিটিগুলিকে দ্রুত কর্মসম্পাদনের উপযোগী করে তোলা। অগ্রাধিকার এলাকা ও ফ্রন্ট চিহ্নিত করে পরিকল্পিত ধারাবাহিক কাজের উদ্যোগ নিতে হবে। ত্রুটি সংশোধন অভিযান উপর থেকে শুরু করতে হবে। সমস্ত ক্ষেত্রেই নেতৃত্বকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন, এই চার ফ্রন্টের সংগ্রাম তিন স্তরেই পরিচালনা করতে হবে। পার্টির বাইরে, পার্টির মধ্যে এবং আমাদের প্রত্যেকের নিজের মধ্যে। পার্টির বাইরে চার ফ্রন্টের সংগ্রামগুলি পার্টির আভ্যন্তরীণ সংগ্রামে প্রতিফলিত হতে বাধ্য। বাইরের সংগ্রাম যত তীব্র হবে পার্টির ভিতরে সংগ্রামও ততই তীব্র হবে। এই সংগ্রামগুলি আবার পার্টির প্রত্যেকটি পার্টিকর্মীর নিজেকে পরিবর্তন করার সংগ্রামে প্রতিফলিত হবে। এতে কেউ কেউ ভয় পেয়ে যান, শত্রুর কাছে আত্মসমর্পন করেন, সম্পদ, পদ ও নিরাপদ জীবনযাপনের হাতছানিতে প্রলুব্ধ হন। এভাবে তাঁদের পদস্খলন ঘটে। অপরদিকে কেউ কেউ ধৈর্য হারিয়ে অতিবিপ্লবী বাস্তবজ্ঞান বিবর্জিত মনগড়া ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয়ে এমন ধরনের সংগ্রাম শুরু করেন যা কার্যত প্রতিবিপ্লবী শক্তির সুবিধা করে দেয়। আবার মধ্যপন্থার নামে কেউ কেউ এই উভয় রকম বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার বদলে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন, পার্টিতে নীতি বিবর্জিত ঐক্য স্থাপনের নিষ্ফলা চেষ্টায় অযথা কালক্ষেপন করেন। শেষোক্ত ঝোঁকটি সবার কাছে ভালো সাজার উদারবাদী ঝোঁক। পার্টির ভিতরের সংগ্রাম নীতি নিয়ে, ব্যক্তি নিয়ে নয়। নীতি স্থির না করে কোনো ব্যক্তিকে সংশোধন করা সম্ভব নয়। পার্টির রণনীতির প্রশ্নে সংগ্রামে আপোষ করা চলে না। কিন্তু দৈনন্দিন কৌশল ও নিছক কাজের প্রশ্নে আপোষহীন সংগ্রাম চলে না। নিজেকে পরিবর্তন করার সংগ্রাম নিজেকেই করতে হয়। কিন্তু কেবল এককভাবে নিজেকে সংশোধন করা যায় না। তার জন্য সমষ্টিগত উদ্যোগ চাই। কমরেডসুলভ মনোভাব নিয়েই ধৈর্যের সাথে এই কাজ করা সহকর্মীদের দায়িত্ব। বিচ্যুতির প্রাথমিক লক্ষ্মণগুলি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তা সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। পার্টির আভ্যন্তরীণ সংগ্রাম ও নিজেকে পরিবর্তনের সংগ্রাম পরিচালনা সম্পর্কে লিও শাও চি আভ্যন্তরীণ সংগ্রামকী করে সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে হবেলিখে গিয়েছেন। আমাদের রাজ্যে আটের দশকের শুরুতেই তা প্রকাশিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রুটি সংশোধন অভিযানের প্রথম দলিল প্রকাশিত হওয়ার বেশ কিছু আগে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি এই সম্পর্কে যে নির্দেশ দিয়েছিল তার মধ্যেও লিও শাও চি-র পুস্তিকাটি পড়তে বলা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় কমিটির এই সংক্রান্ত সর্বশেষ দলিলটি সময়োপযোগী করা হয়েছে, এটাও অবশ্যপাঠ্য বলে বিচার করতে হবে। অবশ্যই এই পাঠ বা চর্চার প্রধান লক্ষ্য হবে পার্টি ও নিজের জীবনে তা নির্দিষ্টভাবে প্রয়োগ করতে পারা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের এবং কেবল আমাদের পার্টিই পারে এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে।

গণশক্তি, শারদ সংখ্যা ২০১৬ 

No comments:

Post a Comment