20161017

ফ্যাসিবাদের পথে অভিযানকে রুখতে হবে প্রস্তুতিপর্বেই

সীতারাম ইয়েচুরি

১৯৯০-এ এল কে আদবানির রথযাত্রার সময় থেকে একটি বিষয়ে আমাকে বারংবার চর্চা করতে হয়েছে। সেই রথযাত্রা দাঙ্গা ও রক্তপাতের রাস্তায় এগিয়েছিল। আর এস এস হলো বি জে পি-র পরিচালক। আর এস এস-র মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত বি জে পি সরকার, বিশেষ করে মোদীর নেতৃত্বাধীন বি জে পি সরকার দেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পথে এগোচ্ছে কিনাএই বিতর্ক ফের সামনে এসেছে। এখন‍‌ও পর্যন্ত ইউরোপীয় ফ্যাসিজমের চরিত্র ও উত্থান সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করেছেন জর্জি ডিমিট্রভ, ১৯৩৫-এ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে তাঁর গভীর বিশ্লেষণমূলক ভাষণে। তিনি ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা দেন : ‘‘লগ্নি পুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী এবং সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী অংশের সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব’’ফ্যাসিবাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এক বুর্জোয়া সরকারের বদলে আরেক বুর্জোয়া সরকারের ক্ষমতায় আরোহণের মতো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। তা হলো শাসকশ্রেণির এক রাষ্ট্ররূপের বদলে আরেক রাষ্ট্ররূপবুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের বদলে খোলাখুলি সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব।

ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল শাসকশ্রেণির শ্রেণি আধিপত্য প্রকৃতপক্ষে সংকটে পড়ায়। শাসকশ্রেণির তরফে তা ছিলো সংকট মোকাবিলার পথ। ১৯২৯-এ মহামন্দা’-র বিশ্ব পুঁজিবাদী সংকট শুরু হয়। হিটলারের ফ্যাসিবাদ শুরুর আগের পর্বে জার্মান একচেটিয়া পুঁজির শ্রেণি আধিপত্যের সংক‌ট তৈরি হয়। শাসকশ্রেণির নিজের শাসনই সংকট ডেকে এনেছিল। ফ্যাসিবাদের বিপদ তৈরি হয় কখনও শাসকশ্রেণির নিজের শিবিরেরই সংকট থেকে, আবার প্রায় একই সঙ্গে সর্বহারা শ্রেণির তরফে শাসকশ্রেণির শ্রেণি-শাসন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায়।
জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের সময়ের সঙ্গে আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি একইরকম নয়। এটা ঠিকই যে চলতি বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট অষ্টম বর্ষে পড়েছে। শ্রমজীবী মানুষের শোষণকে আরো তীব্র করে এই সংকট থেকে বেরোনোর সমস্ত চেষ্টা বিশ্ব ধনতন্ত্রকে আরো গভীরতর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির নেতৃত্বে একচেটিয়া পুঁজিবাদের সংকট নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক সংস্কারের কর্মসূচির মাধ্যমে আদিম সঞ্চয়ের এক ভয়াবহ অভিযানের জন্ম দিয়েছে। এর মাধ্যমে পুঁজি তার মুনাফা সর্বোচ্চ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার প্রত্যক্ষ ফলাফল জনগণের বিপুল অংশের বর্ধিত শোষণ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এবং দেশের মধ্যে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য যেভাবে লাফিয়ে বেড়েছে, তা থেকেই এর আভাস মেলে। আমাদের দেশে দুই ভারত তৈরি হচ্ছে। আমাদের জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ক্রমবর্ধমান দুর্দশা ও বঞ্চনার শিকার। ডিমিট্রভের আলোচনায় আসা একচেটিয়া পুঁজির সংকটের উপাদান রয়েছে কিন্তু ভারতে সর্বহারা শ্রেণি এখনই ক্ষমতা দখল করতে পারে, এমন কোনো পরিস্থিতি নেই। তাছাড়াও দ্রুত বর্ধমান স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা সত্ত্বেও, যা অরুণাচল প্রদেশ বা উত্তরাখণ্ডের ঘটনাবলিতে প্রতিফলিত হয়েছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে খর্ব করা সত্ত্বেও বুর্জোয়া-জমিদার শ্রেণি শাসনের সংকট এই স্তরে পৌঁছোয়নি যে শাসকশ্রেণির আশু কর্মসূচি হয়ে দাঁড়াচ্ছে সংসদীয় গণতন্ত্রকেই বিসর্জন দেওয়া।

সুতরাং, আর এস এস-নেতৃত্বাধীন বি জে পি ক্ষমতায় এসেছে মানেই ধ্রুপদী ইউরোপীয় অর্থে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে, তা নয়। নিঃসন্দেহে আর এস এস-র হিন্দুরাষ্ট্র’-এর ধারণা ফ্যাসিবাদী ধারণা। যদি আর এস এস আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের জায়গায় তাদের হিন্দুরাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠায় সফল হয়, তাহলে গুণগতভাবে সম্পূর্ণ পৃথক পরিস্থিতি তৈরি হবে। সেই পরিস্থিতি যাতে কোনোভাবেই বাস্তবায়িত না হয় বিপ্লবী শক্তিসমূহকে সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিকে তাই আরো যথার্থভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। যে বুর্জোয়া জমিদার শ্রেণি শাসনের সংকট এমন স্তরে পৌঁছেছে যেখানে শাসকশ্রেণির একটি অংশ, সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশআর এস এস/বি জে পি যাদের প্রতিনিধিত্ব করছে তারা এই মুহূর্তে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে সফল হয়েছে। ফ্যাসিস্ত-ধাঁচের হিন্দুরাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এগিয়ে নিয়ে যেতে তারা জোরের সঙ্গে তাকে ব্যবহার করছে।

অনেক সময়ে জর্জি ডিমিট্রভকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের রণ‍‌কৌশলের প্রবক্তা বলা হয়ে থাকে। যেহেতু ফ্যাসিবাদ এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই অনেক সম‍‌য়ে বলা হয় বর্তমান ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে ডিমিট্রভ প্রাসঙ্গিক নন, তাঁর প্রাসঙ্গিকতা হলো প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের রণ‍‌কৌশল তৈরির ক্ষেত্রে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ যুক্তফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এই লাইনের ফলে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্তালিন কমিউনিস্ট-বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মা‍‌র্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আঁতাত তৈরি করতে পেরেছিল। বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিস্ত আধিপত্য ছড়িয়ে দিতে হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। এই সমস্তই ছিলো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, তার অমানবিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গ। যেহেতু ভারতে এখনও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সমস্ত ফ্যাসিবিরোধী শক্তির সাধারণ যুক্তফ্রন্ট গঠনের ডিমিট্রভের বিশ্লেষণ সমসাময়িক ভারতীয় পরিস্থিতিতে খা‍‌টে না।
এভাবে বুঝলে ডিমিট্রভকে ঠিক বোঝা হবে না। বস্তুত সেক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদের উত্থান সম্পর্কে তাঁর সমৃদ্ধ ও অতুলনীয় বিশ্লেষণের প্রতি অন্যায় করা হবে। ১৯৩৫-এ সপ্তম কংগ্রেসে তাঁর রি‍‌পোর্ট, ‘শ্রমিক ঐক্য : ফ্যাসিবাদ বিরোধী দুর্গ’-তে ডিমিট্রভ বলছেন :

দেশের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, তার জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আন্তর্জাতিক অবস্থান অনুসারে বিভিন্ন দেশ ফ্যাসিজমের বিকাশ ও ফ্যাসিস্ত একনায়কত্বও বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। কয়েকটি দেশে, বিশেষ করে যে সব দেশে ফ্যাসিজমের ব্যাপক গণভিত্তি নেই বা যে সব দেশে ফ্যাসিস্ত বুর্জোয়াদের নিজেদের শিবিরের মধ্যেই ঝগড়া কোন্দল বেশ উৎকট সে সব দেশে ফ্যাসিজম চট করে পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে ভরসা পায় নাসেখানে তারা অন্যান্য বুর্জোয়া পার্টি এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিসমূহকে কিছু পরিমাণে আইনগত সুযোগ বজায় রাখতে দেয়। কিন্তু যে সব দেশে বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠী বিপ্লব আসন্ন বলে ভয় পায় সেখানে ফ্যাসিজম অবিলম্বে কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী দল-উপদলগুলিকে দলন করে বা তাদের বিরুদ্ধে বিভীষিকার রাজত্ব তীব্র করে অবাধে রাজ‍‌নৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তার মানে এই নয় যে, অবস্থা বিশেষ জটিল হয়ে দাঁড়ালে প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্বের সঙ্গে পার্লামেন্টারি কার্যক্রমের ধাপ্পাবাজি মিশেল দিয়ে ফ্যাসিজম তার শ্রেণি চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখে গণভিত্তি প্রসারিত করতে চেষ্টা করবে না।

‘‘ফ্যাসিজমের ক্ষমতায় অধিরোহণ একটা বুর্জোয়া গভর্নমেন্টের পরিবর্তে আর একটা বুর্জোয়া গভর্নমেন্টের স্থান অধিকারের মতো সাধারণ ঘটনা নয়। এ হলো বুর্জোয়াশ্রেণির আপন শ্রেণি আধিপত্য বজায় রাখার এক ধরনের রাষ্ট্ররূপ, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বদলে আর এক ধরনের রাষ্ট্ররূপ, প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব স্থাপন। এই পার্থক্য উপেক্ষা করাটা গুরুতর ভুল হবে। এই ভুলের ফলে ফ্যাসিস্তদের ক্ষমতা দখলের আশঙ্কার বিরুদ্ধে শহর ও গ্রামের শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপকতম অংশের সমাবেশ গড়তে বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণি অপারগ হবেন; বুর্জোয়াদের নিজেদের শিবিরেই যে অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়েছে তারও সুযোগ নিতে পারবেন না। কিন্তু আজকের দিনে বুর্জোয়া গণতন্ত্রী দেশগুলিতেও বুর্জোয়া শ্রেণি ক্রমবর্ধমান হারে যে সব প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা অবলম্বন করছেযার ফলে মেহনতি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ধ্বংস হচ্ছে, পার্লামেন্টের অধিকার খর্ব হচ্ছে, ভুয়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং বিপ্লবী আন্দোলনের উপর দমননীতি তীব্রতর হয়ে উঠছেফ্যাসিস্ত একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পথে সে সবগুলির গুরুত্ব ছোট করে দেখাটা মোটেই কম গুরুতর বা কম বিপজ্জনক ভুল নয়।

কমরেডগণ, লগ্নি পুঁজিওয়ালাদের কোন সমিতি একদিন বসে ঠিক করে ফেললো, অমুক তারিখে ফ্যাসিস্ত একনায়কত্ব কায়েম করা হবেফ্যাসিজমের ক্ষমতা দখলের ব্যাপারটাকে অত সহজ, সরল প্রক্রিয়া মনে করাটা ভুল হবে। আসলে, পুরনো বুর্জোয়া দলগুলির বা ঐ সব দলের একটা বিশেষ অংশের সঙ্গে পারস্পরিক, এক এক সময় গুরুতর লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই সাধারণত ফ্যাসিজম ক্ষমতা দখল ক‍‌রে; এমন কি কখন‍‌ও কখনও ফ্যাসিস্তদের নিজেদের শিবিরের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, অনেক সময়জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও অন্যান্য দেশে আমরা যে রকম দেখেছিসশস্ত্র সংঘর্ষের মধ্য দিয়েও ফ্যাসিজম ক্ষমতা হস্তগত করে। ফ্যাসিস্ত একনায়কত্ব কায়েম হওয়ার আগে বুর্জোয়া গভর্নমেন্টগুলি সাধারণত যে কতকগুলি প্রাথমিক স্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর ঝয়,তারা যে একের পর এক প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা চালু করে ফ্যাসিজমের ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত করে দেয়, উপরে বর্ণিত বিষয়গুলি এ সত্য থেকে যেন আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে না ফেলে। যাঁরা বুর্জোয়াশ্রেণির এই সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করেন, যাঁরা ফ্যাসিজ‍‌মের এই প্রস্তুতির যুগে তার বিরুদ্ধে না লড়েন তাঁরা ফ্যাসিজমের বিজয় রুখতে পারবেন না বরং তার জয়ের পথকইে প্রশস্ত করবেন।’’ অর্থাৎ ফ্যাসিবাদকে সংহত হতে সাহায্য করে এমন সমস্ত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের গণসংগ্রাম সংগঠিত করার গুরুত্বের ওপরেই ডিমিট্রভ জোর দিয়েছেন।

কীভাবে ফ্যাসিবাদ বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিজেকে সংহত করে ডিমিট্রভ সে আলোচনাও করেছেন। ফ্যাসিবাদী শক্তি পূর্ণাঙ্গ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েকটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। আজকের বিকাশমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এগুলি প্রাসঙ্গিক।

‘‘জনসাধারণের উপর ফ্যাসিজমের যে প্রভাব রয়েছে তার উৎসটা কি? ফ্যাসিজম যে জনসাধারণকে আকর্ষণ করতে পারছে তার কারণ হলো এই যে, তারা গলাবাজি করে জনসাধারণের জরুরি প্রয়োজন ও চাহিদার কথা বলছে। ফ্যাসিজম শুধু যে জনসাধারণের বদ্ধমূল কুসংস্কারকেই উসকিয়ে তোলে তা নয়, তারা তাঁদের সুস্থ চেতনা, তাঁদের ন্যায়বোধ এমনকি অনেক সময় তাঁদের বিপ্লবী ঐতিহ্যের প্রতিও আবেদন জানায়।’’ মোদী সরকার স্বাধীনতার লড়াইয়ের বিপ্লবী বীর ভগৎ সিং‍‌, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখের নাম করছে নিজেদের কর্মসূচি এগিয়ে নিতে যেতে। জাতীয় আন্দোলনে কোনো ভূমিকা পালন করেনি আর এস এস, স্বাধীনতার জন্য জনগণের বিপুল সংগ্রাম থেকে দূরে দাঁড়িয়েছিলো তারা। সেই আর এস এস এখন জাতীয় বীরদের অনেককে নিজেদের পংক্তির মধ্যে টানতে চাইছে এমন লোকের কাছে পৌঁছোনোর জন্য অন্যথায় যারা তাদের সামাজিক বা রাজনৈতিক ভিত্তির মধ্যে পড়ে না।

ডিমিট্রভ আরো বলছেন: ‘‘ফ্যাসিবাদ চরম সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থেই কাজ করে কিন্তু অন্যায়ের শিকার একটি জাতির স্বার্থরক্ষকের ছদ্মবেশে তারা জনসাধারণের সামনে হাজির হয়...আহত জাতীয় চেতনার কাছে তারা সেইভাবে আবেদন করে।’’ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে কাজ করতে করতে এই বি জে পি সরকার ভারতকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুগত মিত্র বানিয়ে ফে‍লেছে। কিন্তু এক অন্যায়ের শিকারজাতির প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে নিজেদের দেখায়।

অন্যায়ের শিকারহলো হিন্দুরাএই অতিকথনকেই তারা জোরদার করার চেষ্টা করছে। বিদেশি শাসক, মুখ্যত মুসলিমদের শতাব্দীর পর শতাব্দী অসহিষ্ণুতা ও অন্যায়ের শিকার এই জাতির উচিত নিদ্রা থেকে জেগে উঠে সমস্ত বিদেশিদের, অর্থাৎ অ-হিন্দুদের থেকে মুক্ত করে হিন্দু রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্যে তারা জাতীয়তাবাদের নানা ধরনের ধারণা সামনে নিয়ে আসছে। এসব আর কিছুই না সাম্প্রদায়িকতার মুখোশ, যারা তাদের ধাঁচের জাতীয়তাবাদে অনুসরণ করবে না তাদের বিশ্বাসঘাতক’, ‘জাতীয়তা-বিরোধীবলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন। এই পদ্ধতিতে তারা বিরোধীদের মুখ বন্ধ করে ফ্যাসিস্ত ধাঁচের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।

‘‘জনসাধারণকে অবাধে শোষণ করাই ফ্যাসিজমের লক্ষ্য। কিন্তু দস্যু বুর্জোয়াশ্রেণি ব্যাঙ্ক, ট্রাস্ট ও রাঘববোয়াল পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের যে সুগভীর ঘৃণা রয়েছে তার সুযোগ নিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে পুঁজিবাদবিরোধী গলাবাজি করে তারা জনসাধারণের কাছে আবেদন জানায়এমন সব দাবি উপস্থিত করে যা রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ক জনসাধারণের কাছে সেই মুহূর্তে সবচেয়ে লোভনীয় বোধ হয়।’’ লক্ষ্য করা যেতে পারে জনধন যোজনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে স্লোগান সামনে আনছেন (যদিও এই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলির বিরাট অংশই অচল বা শূন্য ব্যালান্সের)। জনগণকে প্রলোভিত করার চেষ্টা হচ্ছে। অথচ এই সরকারের অর্থ‍‌নৈতিক নীতি জনগণের ওপরে ক্রমশই বেশি বেশি বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।

‘‘ফ্যাসিজম জনসাধারণকে সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ, সব থেকে বিষাক্ত মনোবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের গ্রাসে তুলে দেয়, কিন্তু জনসাধারণের দরবারে তারা হাজির হয় ‘‘সৎ এবং দুর্নীতির ছোঁয়াচহীন গভর্নমেন্ট’’ গঠনের দাবি নিয়ে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক গভর্নমেন্টসমূহ সম্পর্কে জনসাধারণের সুগভীর মোহমুক্তির উপর ভর করে ফ্যাসিজম কপটভাবে দুর্নীতির নিন্দা করে।’’ প্রধানমন্ত্রী একটানা বাগাড়ম্বর করে চলেছেন যে ভারতে এই প্রথম একটা সরকারের কোনো দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি নেই। একই সঙ্গে এই সরকার নির্বিচার ধান্দার ধনতন্ত্রকে মদত দিচ্ছে। সংসদেই স্বীকার করা হয়েছে, ২০১৫-১৬ সালে কর্পোরেটদের ৫৯,৫৪৭ কোটি টাকার ঋণ মকুব করা হয়েছে। এ হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। কর্পোরেটকে কর ছাড়ের বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ৬ লক্ষ কো‍টি টাকা। অন্যদিকে, সামান্য ঋণের টাকা শোধ করতে পারার মতো পরিস্থিতিতে না থাকায় একজন কৃষককে শাস্তি পেতে হচ্ছে। তার সম্পত্তি, গোরু-মোষ কেড়ে নিচ্ছে সেই একই ব্যাঙ্কগুলি যারা ভারতের শীর্ষ কর্পোরেটদের ৮.৫ লক্ষ কোটি টাকা এমন ঋণ দিয়েছে যা ফেরতের আশা প্রায় নেই। আক্ষরিক অর্থেই ‘‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত, সবচেয়ে বিষাক্তদেরগ্রাসে তুলে দেওয়া হচ্ছে জনসাধারণকে।

‘‘বুর্জোয়া শ্রেণির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল মহলের স্বার্থেই ফ্যাসিজম পুরানো বুর্জোয়া পার্টিগুলোর উপর বীতশ্রদ্ধ জনসাধারণকে মাঝপথে পাকড়াও করে। বুর্জোয়া গভর্নমেন্টের উপর আক্রমণের তীব্রতা এবং পুরানো বুর্জোয়া দলগুলি সম্পর্কে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে তারা এইসব সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে।’’ পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে প্রত্যেক বিদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলে চলেছেন গত ৬০ বছরের কংগ্রেস শাসনের ধ্বংসাবশেষ থেকে তাঁর সরকার ভারতকে পুনর্নির্মাণ করছে। গত দুবছরে যদিও ধনী-দরিদ্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো তীব্র হয়েছে। আজ ভারতীয়দের শীর্ষ এক শতাংশ দেশের মোট সম্পদের অর্ধেকেরই মালিক। ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, গরিবরা আরো গরিব। যদিও এই সরকারের প্রচারের ধরন এমন যেন পুরানো বুর্জোয়া দলগুলি সম্পর্কে তাদের আপসহীন মনোভাব।

‘‘নৈরাশ্যবাদ ও কপটতায় ফ্যাসিজম অন্য সব রকম বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াকে ছাড়িয়ে যায়। একটা দেশের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, এমন কি একই দেশের বিভিন্ন সামাজিক স্তরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ফ্যাসিজম তার প্রচারের ধরন ঠিক করে। অভাব-অনটন, বেকারি ও জীবনের অনিশ্চয়তায় হতাশাগ্রস্ত পেটি-বুর্জোয়া জনতা, এমন কি শ্রমিকশ্রেণির একাংশও সহজেই ফ্যাসিজমের সমাজতান্ত্রিকএবং সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ভাঁওতাবাজীর শিকার বনেন।’’ ফ্যাসিস্ত-ধাঁচের বাকচাতুর্য ছাড়াও আর এস এস/বি জে পি সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা সামাজিক বিন্যাসের খেলা চালাচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক স্তরের সঙ্গে খাপখাইয়ে তারা একেকটি জাত-সম্প্রদায়ের মধ্যেকার উপ-জাত সম্প্রদায়কেও সমবেত করে তাদের মধ্যে সামাজিক ভিত্তি গঠনের চেষ্টা করছে। ফ্যাসিবাদ-মূলত উগ্র জাতীয়তাবাদী বাগাড়ম্বরের দ্বন্দ্বে এই সামাজিক বিন্যাসও ফ্যাসিস্তধাঁচের মতাদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সমসাময়িক ভারতীয় পরিস্থিতিতে ডিমিট্রভের কথার সঙ্গে এমন অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। এই পরিস্থিতিতে মোদী সরকার ফ্যাসিস্ত সরকার কি না তা নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলা বিতর্কেই ডুবে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা আগেই বলেছি, এই সরকার এখনও ফ্যাসিস্ত সরকার নয়। সুতরাং আজকের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাধারণ যুক্তফ্রন্টের রণকৌশল প্রাসঙ্গিক না। যে বিয়ষটি জোর দিয়ে বলার মতো তা হলো যদি আগেই প্রতিহত করা না যায় মোদী সরকার আর এস এস-র ফ্যাসিস্ত ধাঁচের হিন্দুরাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার দিকে যাত্রা করবে। এই যাত্রা যাতে এগোতে না পারে, তাকে থামানো দরকার। আজ আমরা যা দেখছি তা এখনও ফ্যাসিবাদ নয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদী পদ্ধতিগুলির নির্মম এবং শিউরে ওঠার মতো ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। আর এস এস-র আপাদমস্তক অসহিষ্ণু ফ্যাসিস্ত-ধাঁচের হিন্দু রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই অভিযান চালানো হচ্ছে। এই হিন্দুরাষ্ট্রগঠিত হতে পারে কেবলমাত্র আমাদের বর্তমান সাংবিধানিক সাধারণতন্ত্রের ধ্বংসাবশেষের ওপরে। সমস্ত কমিউনিস্ট, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও সমস্ত দেশপ্রেমিক ভারতীয়ের কর্তব্য হলো ফ্যাসিবাদের পথে এই যাত্রাকে প্রতিরোধ ও পরাস্ত করা। সি পি আই (এম)-র ২১তম কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এই সাম্প্রদায়িক অভিযানকে মোকাবিলার প্রধান কর্তব্যসম্পাদনে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির সংগ্রামে আরো জোরদার ঐক্য গঠন করতে হবে। (রচনাকাল : ৩১শে আগস্ট, ২০১৬)

গণশক্তি, শারদ সংখ্যা ২০১৬


No comments:

Post a Comment