ডা: সূর্যকান্ত
মিশ্র
একশ বছর
আগে লেনিন লিখেছিলেন ‘সাম্রাজ্যবাদ: পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’। এই পুস্তিকা ছিলো
আয়তনে ছোট, মুখ্যত ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে মতবাদিক লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে
রচিত। এই পুস্তিকায় লেনিন সাম্রাজ্যবাদের পাঁচটি মুখ্য চরিত্রকে চিহ্নিত করেছিলেন।
একচেটিয়ার প্রাধান্য, ব্যাঙ্ক ও শিল্প পুঁজির মিলনে লগ্নী পুঁজির উদ্ভব ও
আধিপত্য,পণ্য রপ্তানি অপেক্ষা পুঁজির রপ্তানির প্রাধান্য, বিশ্বজোড়া কার্টেল এবং
ধনতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে বাজার ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দুনিয়াজোড়া
ভৌগোলিক ভূমির বন্টন ও পুনর্বন্টন। যার ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
লেনিন এই
পুস্তিকা লেখার সময়ে সমসাময়িক আরো কয়েকজন লেখকের গবেষণা নিয়ে চর্চা করেছিলেন। জন
আটকিনসন হবসন তাঁদের অন্যতম। রাজনৈতিক ধ্যানধারণার দিক থেকে সামাজিক উদারবাদী হলেও
সাম্রাজ্যবাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যকে তিনি চমৎকার ভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।
সাম্রাজ্যবাদী মনস্তাত্বিক যুদ্ধ সম্পর্কে চর্চার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী।
মার্কসবাদী পথের এই সংখ্যায় হবসন সম্পর্কে অঞ্জন বেরার লেখা সংযোজিত হয়েছে।
লেনিনের
মূল সুত্রগুলি কার্যকরী থাকলেও তাঁর সময় থেকে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে। পুঁজির
কেন্দ্রীভবন আরো গতি পেয়েছে এবং তা আন্তর্জাতিক চেহারা পেয়েছে। তেমনই
উল্লেখযোগ্য লগ্নী পুঁজি এখন আর জাতীয়
চরিত্রের নেই, তা আন্তর্জাতিক চেহারা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির অবাধ
চলাচলের স্বার্থেই দেশে দেশে অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ হচ্ছে। বিশ্বায়নের কেন্দ্রে
রয়েছে এই লগ্নী পুঁজিই। একই সঙ্গে উৎপাদনের
আন্তর্জাতিকীকরণও ঘটেছে। তুলনামূলক ভাবে সস্তা কাঁচা মাল ও মজুরির ভূখণ্ডে পুঁজি
রপ্তানি করে সস্তায় উৎপাদন করিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার ফলশ্রুতিতে উন্নত
পুঁজিবাদী দেশগুলির শ্রমিকদের মজুরির হার হয় একই জায়গায় থেকে যাচ্ছে নয়তো প্রকৃত
মজুরির হার কমে যাচ্ছে।
বস্তুত
মজুরির হারকে স্থির জায়গায় রেখে দেওয়া বা সংকোচন পুঁজির মূল লক্ষ্য হিসাবে কাজ
করছে। পরিধির শ্রমজীবী জনতার আয়ের স্ফীতি সংকোচন করেও পুঁজি এই অতিরিক্ত মুনাফা
সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। মার্কসবাদী পথের এই সংখ্যায় উৎসা পট্টনায়েক ও প্রভাত
পট্টনায়েকের লেখায় বিশ্বায়নের পর্বে পুঁজির মূল কেন্দ্রগুলির সঙ্গে পরিধির
অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিকাশ নিয়ে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। শ্রমশক্তির বাজারে সংরক্ষিত
বাহিনী বেকারের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রকৃত মজুরি কমিয়ে রাখার কৌশলের বিষয়টি এই লেখায়
বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই লুন্ঠনের পরিধিগুলির অধিকাংশই একসময়ে উপনিবেশ ছিলো। বিগত
শতাব্দীর পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকে এই সদ্যস্বাধীন দেশগুলিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে
রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদ নয়া উপনিবেশবাদী নীতি নিয়ে চলেছে। তা নিয়ে দ্বন্দ্বও অনেক
বেশি তীব্র ও দৃশ্যমান ছিলো। নয়া উপনিবেশবাদী নীতি কার্যকর করতে গিয়ে বাধার মুখে
পড়লে সামরিক ভাবে আগ্রাসনও চালিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ। বিশ্বায়নের পর্বে কয়েকটি মূল
অর্থনৈতিক নীতি প্রায় সব দেশেই রূপায়িত হচ্ছে। অনেকে একে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ বলেও
অভিহিত করেন। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির দাপট ছাড়াও উন্নয়নশীল দেশগুলির শাসক শ্রেণীগুলি
ক্রমেই তাদের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্কে যুক্ত হচ্ছে বলেই এই কাজ তুলনায় মসৃণ ভাবে
সম্পন্ন হতে পারছে।
একথা ঠিকই
যে লেনিনের সময়ের মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব এখন ফেটে
পড়ছে না। বিশ্বায়নের ফলে সব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরই বাজার বিস্তারের সুযোগ ঘটে
যাওয়া তার একটি কারণ। অন্য কারণগুলির মধ্যে অন্যতম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য। এর ফলেই আন্তঃ সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বগুলি স্তিমিত
হয়ে রয়েছে। কিন্তু এ কথা বলা যায় না যে এই দ্বন্দ্ব চিরকালের জন্য নিরসন হয়ে গেছে।
বরং বিশ্ব অর্থনীতির একটানা সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে এই দ্বন্দ্ব নতুন করে সামনে
আসতে পারে, এমন সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। ২০০৭-০৮-এ প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরে
ইউরোপে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয় তার ফলে বিকাশের গতি ধীর হয়ে গেছে। এই সঙ্কট
থেকে মুক্তির কোনো নির্দিষ্ট লক্ষণ এখনও নেই, বরং ২০১৬ হলো পরপর পঞ্চম বছর যখন
বিশ্বের গড় বিকাশের হার ৩.৭শতাংশের নিচে রয়ে গেছে। ১৯৯০ থেকে ২০০৭’র বিকাশের হারে
কোনো ভাবেই পৌঁছোতে পারছে না বিশ্ব অর্থনীতি। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও কার্যত
মন্দাই চলছে, বেকারীর হার বাড়ছে, সামাজিক সুরক্ষা কমছে। ব্যয়সঙ্কোচের নামে
শ্রমজীবী মানুষেরই ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বেশি বেশি বোঝা।
এই
প্রেক্ষাপটে একদিকে যেমন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক শ্রেণী আন্দোলন সংগ্রামের পথ
নিয়েছেন, অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। ব্রিটেন
গণভোটে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার। গণভোটের এই রায়ের পিছনে
বামপন্থী বা ব্যয়সঙ্কোচ বিরোধী মানুষের সমর্থনও যেমন রয়েছে, দক্ষিণপন্থী
শক্তিগুলিও এই গণভোটকে ব্যবহার করেছে এবং করে চলেছে। বিশেষ করে অভিবাসীদের
বিরুদ্ধে, এমনকি ইউরোপেরই অন্যান্য দেশ থেকে ব্রিটেনে কাজ করতে যাওয়া বিভিন্ন
অংশের শ্রমজীবীর বিরুদ্ধে বৈরিতা তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। (ব্রেক্সিট নিয়ে একটি
শান্তনু দে’র আলোচনা এই সংখ্যায় রয়েছে)। প্রশ্ন উঠেছে, ব্রিটিশ পুঁজির একটি অংশ কি
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে আগ্রহী হয়েছিল? ব্রিটেনের দুই প্রধান দল
কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টির মধ্যেই এই প্রশ্নে বিভাজন স্পষ্ট। ফ্রান্স, ডেনমার্ক,
জার্মানিতেও এমন দাবি উঠেছে। আবার, কয়েকদিন আগে জি-২০’র শীর্ষ বৈঠকেও দেখা গেছে
সঙ্কট থেকে অর্থনীতি বেরোতে পারছে না। পরিত্রাণের পথ কী, তা নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট
মতৈক্যে পৌঁছোনোও অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বরং ‘সংরক্ষণবাদ’ নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে
অভিযোগ উঠেছে। নিজের দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে সংরক্ষণের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে বলে
অভিযোগ উঠছে। সঙ্কট থেকে মুক্ত হতে পারছে না বলেই এই দ্বন্দ্বগুলি সামনে আসতে শুরু
করেছে। বিশ্বায়নের মধ্যে থেকে যাওয়া দ্বন্দ্বগুলি সামনে আসতে শুরু করেছে। এই
প্রবণতার প্রতি সতর্ক নজর রাখা প্রয়োজন।
পুঁজিবাদের
এহেন সঙ্কটের সময়ে অতি দক্ষিণপন্থা, উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাতিবিদ্বেষ মাথা চাড়া দিয়ে
থাকে। তিরিশের দশকে ইউরোপ তার সাক্ষী। মহামন্দার পরিণতিতে, ইউরোপের অস্থিরতার
সুযোগে বিশেষ করে জার্মানিতে নাৎসিরা ক্ষমতা দখল করেছিল। ইতালিতে যেমন তার আগেই
ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় চলে আসে তেমনই ইউরোপের আরো অনেকগুলি দেশে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক
শক্তি মাথাচাড়া দেয়। কখনও ‘আহত জাতিসত্ত্বার’ ধুয়ো তুলে, কখনো সঙ্কটে জর্জরিত
সাধারণ মানুষকে সুদিনের স্বপ্ন দেখিয়ে ফ্যাসিবাদ সমর্থনও আদায় করেছিল। শেষ পর্যন্ত
ফ্যাসিবাদ আর নিজ দেশের পরিধিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সাম্রাজ্যবাদের চেহারা নিয়ে
একের পর এক দেশে ভূখন্ড দখলের আগ্রাসনও চালিয়েছিল। যার পরিণতিতে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ এবং ভয়ঙ্কর ক্ষয়ক্ষতি। এখন তা সম্ভবপর না হলেও পৃথিবীতে স্থানীয়
যুদ্ধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এম এ বেবির লেখায় তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা পাওয়া
যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অতি দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির বিকাশ নজর না
করে উপায় নেই। ২০১৪সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত সদস্যদের এক চতুর্থাংশ
উগ্র দক্ষিণপন্থী বা ফ্যাসিস্তধর্মী দলগুলির প্রতিনিধিত্ব করছেন। এমনকি ইউরোপের
বেশ কয়েকটি দেশে এই শক্তিগুলি নির্বাচনে খুবই ভালো ফলাফল করতে পারে বলেও
পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করছেন। হাঙ্গেরিতে ইতোমধ্যেই কট্টর দক্ষিণপন্থী এবং
অভিবাসী-শরণার্থী বিরোধীরা সরকারে রয়েছে। নেদারল্যান্ডসে অতি দক্ষিণপন্থী ফ্রিডম
পার্টির গণভিত্তি রয়েছে, তারাও ই ইউ থেকে বেরিয়ে আসায় গণভোট দাবি করেছে। ফ্রান্সে
ন্যাশনাল পার্টি আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসে নির্বাচনে জিতবে বলে প্রচার অতিরঞ্জিত
হলেও পৃথকত্ব ও উগ্র জাতীয়তার যে প্রবণতা ইউরোপজুড়ে দেখা যাচ্ছে, তার প্রভাব
ফ্রান্সেও পড়তে বাধ্য। জার্মানিতেও অলটারনেটিভ ফর ডয়েশল্যান্ড-এর মতো দল সামনে চলে
এসেছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের দল তাঁর নিজের প্রদেশে পরাস্ত
হয়েছে। গ্রিসে গোল্ডেন ডন মাথা চাড়া দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই প্রবণতা ই ইউ-র
প্রধান শক্তি ফ্রাঙ্কো- জার্মান পুঁজির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। কমিউনিস্ট
আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে জর্জি ডিমিট্রভ দেখিয়েছিলেন এই শক্তিগুলি অর্থনৈতিক
সঙ্কটে জর্জরিত এবং শাসক শ্রেণীর অন্যান্য দলগুলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ সাধারণ মানুষকে
‘মধ্যপথে পাকড়াও করে’। উপরন্তু এক সময়ে সাম্রাজ্যবাদী মদতেই সৃষ্ট আন্তর্জাতিক
সন্ত্রাসবাদ ও তার ফলশ্রুতিতে হিসাবে শরণার্থী স্রোতকে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরির কাজে
ব্যবহার করা হচ্ছে।
উন্নয়নশীল
দেশগুলিতেও দক্ষিণপন্থী শক্তির বিকাশের দিকে আমরা নজর না দিয়ে পারি না। এই সব
দেশে, আগে যাদের তৃতীয় বিশ্ব বলা হতো, অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপরে আক্রমণ
বেড়েই চলেছে। ভারতেও স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অর্জিত মানুষের
অধিকার, মূল্যবোধ, রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রগতিমুখী উপাদান গুরুতর আক্রমণের মুখে।
মার্কসবাদী পথের এই সংখ্যায় সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির
‘ভারতের ধারণা’ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষণের পূর্ণাঙ্গ বয়ান প্রকাশিত হলো।
ভারতের ধারণা নিয়ে বিতর্ক আদৌ বিমূর্ত বিতর্ক নয়। আর এস এস ও সঙ্ঘ পরিবার যে ‘ভারত’ তৈরি করতে চাইছে তা
ভারতের সংস্কৃতির বিরোধী, মিশ্র ও বহুত্ববাদী গঠনের বিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতার বৈরি।
তাদের ঘোষিত লক্ষ্য তথাকথিত ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গঠন করা। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে
যে ভারতের লক্ষ্য নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন, সঙ্ঘ পরিবারের ‘ভারত’ তা
থেকে বহু দূরে। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার খুবই জোরালো মতাদর্শগত অভিযান চালাচ্ছে,
সামাজিক বহু সংগঠনের মধ্যে দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষা ও
বুদ্ধিবৃত্তির জগতে তারা দখলদারি কায়েম করতে চাইছে। এই অভিযানের এখন ‘স্বর্ণযুগ’
চলছে কেননা একক গরিষ্ঠতা নিয়েই কেন্দ্রে বি জে পি সরকার গঠন করতে পেরেছে। সঙ্ঘ
পরিবার গণতন্ত্রের ধারণায় বিশ্বাস করে না, হিন্দু পরিচিতিসত্ত্বাকে রাজনৈতিক ভাবে
ব্যবহার করাই তাদের লক্ষ্য। যদি প্রয়োজন হয় এবং সেই সক্ষমতা তারা অর্জন করতে পারে
তারা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে দিতে তারা আদৌ দ্বিধা করবে না।
ইতোমধ্যেই এই সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক কাজের ধরন স্পষ্ট হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সর্ব
ক্ষমতার উৎস এমন ধারণাও প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। খুবই লক্ষণীয় এই যে দেশের বৃহৎ
পুঁজির উল্লেখযোগ্য অংশ আর এস এস- বি জে পি’র চরিত্র বুঝেও তাদের সমর্থন করছে।
সঙ্ঘ পরিবার এবং বি জে পি-ও কর্পোরেটের স্বার্থে, দেশ-বিদেশের পুঁজির স্বার্থে
একের পর এক কাজ করছে। বাগাড়ম্বর যাই হোক না কেন, ভারতের অর্থনীতি সঙ্কটমুক্ত নয়।
মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বৃদ্ধির হার নিয়ে সরকারী দাবিতে সংশয় প্রকাশ করছেন
অর্থনীতিবিদদের বড় অংশই। কৃষিতে স্পষ্টতই সঙ্কট গভীরতর হয়েছে, শিল্পোৎপাদনের সূচক
ক্রমেই নামছে, বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে। কেন্দ্রেরই শ্রম মন্ত্রকের
হিসেব কর্মসংস্থানের হার সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। দেশের অর্থনীতির স্বনির্ভর
ভিত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সর্বনাশ ঘটানো হচ্ছে। লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত
সংস্থাগুলিরও বেসরকারীকরণের লক্ষ্যে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি শেয়ার বিক্রির পথে চলেছে
কেন্দ্র। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যা বিদেশী
পুঁজির জন্য খুলে দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে,
অতীতের যে কোনো সরকারের তুলনায় নরেন্দ্র মোদী সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সঙ্গে সামরিক-রাজনৈতিক সম্পর্ককে দৃঢ় করছে। বিশেষ করে এশিয়ায় মার্কিন রণনীতির শরিক
হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভারত। সম্প্রতি মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে পরিকাঠামোগত সাহায্য
বিনিময়ের প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ফলে মার্কিন সেনাবাহিনী
ভারতের তিন বাহিনীর ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। এই চুক্তি সইয়ের পরে ওয়াশিংটনে যে
যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন হয়েছিল সেখানে দু’দেশের ‘যৌথ সামরিক অভিযানের’ কথাও বলা
হয়েছে।
এমন
পরিস্থিতিতে শাসক শ্রেণীর এই অংশ, যারা এখন সরকারী ক্ষমতায় আছে, ভবিষ্যতে
গণতন্ত্রের পক্ষে আরো ধ্বংসাত্মক শক্তিতে পরিণত হতে পারে। ভারতে ইউরোপীয় ধাঁচে
ফ্যাসিবাদ বিকশিত না হলেও বিপদ থেকেই যাচ্ছে। সেই বিপদ যাতে বাড়তে না পারে, সেই
স্তরেই পালটা তৎপরতা দরকার বামপন্থী, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে। সি পি
আই (এম)-র সর্বভারতীয় প্লেনামে বলা হয়েছে, সঙ্ঘ পরিবারকে যথাযথ ভাবে মোকাবিলা করতে
হলে সামাজিক, মতাদর্শগত ক্ষেত্রে নিবিড় লড়াই চালাতে হবে। সি পি আই (এম) এবং
বামপন্থীদেরই এ কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে। অন্যদের টেনে আনার কাজও তখনই সম্ভব যখন
বামপন্থীরা স্বাধীন শক্তিতে এই লড়াই পরিচালনার মতো সাংগঠনিক জোর অর্জন করবে।
সারা দেশে
সি পি আই (এম) এবং বামপন্থীদের শক্তি কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নেই। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের
একটানা তীব্র সন্ত্রাস, বহু ক্ষেত্রে ভোট অবাধ না হওয়া, সি পি আই (এম) ও
বামপন্থীদের সাংগঠনিক দুর্বলতা বিধানসভা নির্বাচনে ফল খারাপ হওয়ার মুখ্য কারণ। এই
ফলাফল অপ্রত্যাশিত হওয়ার কারণ নির্বাচনের পূর্বে যে কিছুটা ভিত্তিহীন কিন্তু বিরাট
প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল পরে তা হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। নির্বাচনের সময়ে এবং পরেও বি
জে পি এবং তৃণমূলের মধ্যে সমঝোতা ও পরস্পরের জন্য জমি তৈরির খেলা স্পষ্ট হচ্ছে।
এছাড়া, আগেও কেরালা, পশ্চিমবঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের কমিউনিস্ট-বিরোধিতায় মদত নতুন কথা
নয়। এখন ত্রিপুরায় সমস্ত কমিউনিস্ট-বিরোধী শক্তি একজোট হচ্ছে। এসব সত্ত্বেও মনে
রাখতে হবে ২ কোটি ১৫লক্ষ মানুষ তৃণমূল ও বি জে পি-র বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন।
নির্বাচনের
পরেও তৃণমূলের তরফে সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে। ভারতে কোনো রাজ্যেই বিরোধীদের এইধরনের
একটানা স্বৈরাচারী আক্রমণ সহ্য করতে হচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতির উপযুক্ত পার্টি
সংগঠন গড়ে তুলতে সাংগঠনিক পুনর্বিন্যাস, গণ লাইনকে কার্যকর করতে নিবিড় জনসংযোগ,
উন্নত মতাদর্শগত মান অর্জন খুবই প্রয়োজনীয়। সর্বভারতীয় প্লেনামের মতো পশ্চিমবঙ্গেও
পার্টির সাংগঠনিক প্লেনামে অন্যতম মুখ্য বিষয় হলো গত পঁচিশ বছরে নয়া উদারনীতির
কারণে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও বিভিন্ন শ্রেণীর ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনগুলি হয়েছে,
তার প্রভাব মাথায় রেখে আন্দোলন ও সাংগঠনিক কাজের অভিমুখ স্থির করা। শ্রমিক শ্রেণী,
কৃষির সঙ্গে যুক্ত শ্রেণীগুলি, মধ্যবিত্ত ও শহর এলাকায় কাজের ধারার পুনর্বিন্যাস
প্রয়োজন। সেই কাজ করেই স্বৈরাচারী শক্তিকে মোকাবিলা করে বামপন্থী আন্দোলনকে এগিয়ে
যেতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
‘মার্কসবাদী পথ’, আগস্ট ২০১৬
No comments:
Post a Comment