20160905

নয়া-উদারবাদের ২৫বছর: শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিরোধ


এ কে পদ্মনাভন

শ্রমিকশ্রেণী হলো দেশে নয়া-উদারবাদী জমানায় আক্রমণের মুখ্য লক্ষ্যবস্তু। ১৯৯১ সালে এই নীতি ঘোষণার প্রথম দিন থেকেই শাসকশ্রেণী এবং নীতি-নির্ধারকরা শ্রমজীবী মানুষ এবং তাঁদের কষ্টার্জিত অধিকারকে আক্রমণ করেই নীতি শানিয়েছে।

এমনকি যখন আরও বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা হয়, তখনও কর্তৃপক্ষ কেবলমাত্র ‘ব্যাঙের ছাতা’-র মতো গজিয়ে ওঠা ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যাধিক্য এবং শ্রম আইনগুলির অনমনীয়তাকেই দোষারোপ করতে থাকেন। এরসঙ্গে, এখন ‘নমনীয়তা’ এবং ‘কর্মসঙ্কোচন’-এর মতো স্লোগানগুলি গোটা দেশে যে সঙ্কট নেমে এসেছে, তার থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। 

গত ২৫বছরে ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর অভিজ্ঞতা হলো, দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলির আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে, যদিও তখন তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়নি। একমাত্র যারা বামপন্থী বৃত্তে ছিলেন, তাঁরাই উপলব্ধি করেছিলেন যে এই নীতিগুলি রূপায়িত হলে দেশে বিপর্যয় নেমে আসবে। 

১৯৯১সাল থেকে এই নয়া-উদারবাদী ‘সংস্কার’ রূপায়ণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। দেশের  শ্রমজীবী জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল শ্রম আইনগুলি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়। শ্রমিকের তাঁর পছন্দমতো একটি ইউনিয়ন গড়ার অধিকারও এর মধ্যে পড়ে। ১৯২৬সালে দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আইন প্রণয়ন হয়। এটা ঘটনা যে ব্রিটিশ আমলে এই আইন প্রণীত হলেও জাতীয় স্তরে কর্তৃপক্ষকে একটি ট্রেড ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক না করায় স্বাধীন ভারতে এখনও পর্যন্ত শ্রমিকদের যৌথভাবে দর কষাকষির অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া যায়নি। 

শ্রম আইনগুলির ক্ষেত্রে এই ‘সংস্কার’-এর রূপায়ণের বিভিন্ন দিক আছে, যারমধ্যে রয়েছে বর্তমানে চালু শ্রম আইনগুলি প্রয়োগ না করা; এই আইনগুলিকে প্রয়োগে বাধ্য করার জন্য সরকারী যে ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সেগুলি গুটিয়ে ফেলা এবং চালু আইনগুলিতে নতুন করে শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী সংশোধনী আনা। কিন্তু, ব্যাপক ধর্মঘটসহ তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন এবং দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রধান দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কেন্দ্রে পরপর জোট সরকার গঠিত হওয়ায় এই প্রচেষ্টায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।   

গত ২৫বছর ধরে গণতান্ত্রিক ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের ওপর আক্রমণ নেমে আসা সত্ত্বেও তাই বড় আকারের কোনো সংশোধনী গৃহীত হতে পারেনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন যে সব শিল্প গড়ে উঠেছে, সেসব জায়গায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার কার্যত অস্বীকার করা হচ্ছে। শুধুমাত্র বহুজাতিক সংস্থাগুলিতেই নয়, ভারতীয় কর্পোরেটরাও, যাদের অন্যত্র তাদের সংস্থায় এই অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হয়েছে, তারাও এই ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাগুলিক অনুকরণ করছে।

এই পরিস্থিতিতে, কর্তৃপক্ষ সহজেই শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারছে। স্থায়ী ধরণের কাজের অস্থায়ীকরণ এবং ঠিকাকরণ করাই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন শ্রমিকরা শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইউনিয়ন গড়ার দাবিতে ময়দানে নামছে, তখনই এমন ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে, যে একজনও নিয়মিত শ্রমিক না রেখে কিভাবে কোনো কারখানায় বছরের পর বছর উৎপাদন চালিয়ে গেছে।  

এর ফল হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমশক্তির ৬০শতাংশের বেশি এমনকি বিধিবদ্ধ ন্যুনতম মজুরি এবং ই এস আই ও ই পি এফ-এর মতো সামাজিক নিরাপত্তাগুলি পাচ্ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ৫০শতাংশের বেশি এবং বেসরকারী ক্ষেত্রের ৭০শতাংশের মতো শ্রমিক ঠিকা ভিত্তিতে কাজ করছেন। এই সমস্ত শ্রমিক বিভিন্ন নামে স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদী এবং ধারাবাহিক কাজে নিযুক্ত রয়েছেন, যা ঠিক শ্রমিক (নিয়ন্ত্রণ ও বিলোপ) আইন এবং অন্যান্য শ্রম আইনের সম্পূর্ণ বিরোধী। বহু প্রতিষ্ঠানে ১২ঘন্টা কাজ করা এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর আরেকটি দিক হলো, শিল্পক্ষেত্রে মজুরির অংশ ক্রমশ কমছে, ১৯৮২-৮৩সালে যেখানে এটা ছিল ৩০শতাংশ, সেখানে ২০১২-১৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১২.৯শতাংশে। আবার মজুরির হার যখন কমছে, তখন মালিকদের মুনাফার অংশ একই সময়ে ২০শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে।

১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩সাল পর্যন্ত এই পরিস্থিতি একই গতিতে এগিয়েছে, যদিও এই সময়ে বিভিন্ন দল বা জোটের সরকার ছিল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এন ডি এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। মোদী সরকার আরও ‌আগ্রাসী পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলছে।   

কাজের সুযোগ ক্রমশ কমতে থাকায়, শোষণের মাত্রা বহুমুখী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংগঠিত, অসংগঠিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারী-সমস্ত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি। এদের সঙ্গে রয়েছেন বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পে স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে যুক্ত কর্মীরা, যারা শুধুমাত্র একটা সাম্মানিক পান, যাদের মোট সংখ্যা প্রায় ১কোটি।

কেন্দ্রের মোদী সরকার গত ২৬মাসে একগুচ্ছ শ্রম আইন সংশোধনীর প্রস্তাব রেখেছে। ইতিমধ্যে, সরকার  ঘোষণা করেছে যে ৪৪টি শ্রম আইনকে তারা ৫টি শ্রম কোডে পরিবর্তিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত ধারাগুলি তুলে নেওয়া হবে। সংসদে এই মজুরি কোড বিল ও শিল্প সম্পর্ক কোড বিলের খসড়া পেশ করার জন্য তৈরি হয়ে গেছে। কারখানাসমূহ সংশোধনী বিল ইতিমধ্যেই সংসদে পেশ করা হয়েছে, সরকার এই বিলের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডিং কমিটির সমস্ত সুপারিশ বাতিল করেছে এবং এই বিলের পশ্চাদ্‌গামী সংশোধনী কার্যকর করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। একই সঙ্গে, আরেকটি নতুন বিল-ছোট কারখানাসমূহ বিল-ও তৈরি হয়ে গেছে। এই দুটি বিলের নেট ফল হবে যে ৭৫শতাংশের বেশি কারখানা শ্রমিক কারখানাসমূহ আইনের আওতার বাইরে চলে যাবে এবং ন্যুনতম মজুরি আইন, মাতৃত্বকালীন আইন, ই এস আই, ই পি এফ-সহ ১৪টি মৌলিক শ্রম আইনের বাইরে তাদের ঠেলে দেওয়া হবে।    

শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, অনেক রাজ্য সরকারও, বিশেষ করে বি জে পি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই ধরণের শ্রম আইন সংশোধন চলছে, কেন্দ্রের আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। কার্যত, রাজস্থান সরকার এই প্রশ্নে নেতৃত্ব দিচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে রাজস্থান সরকারকে অনুসরণ করার জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে বলা হয়েছে। 

১৯৯১ সাল থেকেই শ্রমজীবী মানুষ এই নীতিগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে আসছে। বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ নেমে আসা সত্ত্বেও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলছে। দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মঘটে শামিল হয়েছে শ্রমিকশ্রেণী।

দেশের সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন  আন্দোলনের সাফল্য এটাই যে সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও জাতীয় স্তরের কর্মচারী ফেডারেশনগুলি নয়া-উদারবাদী নীতিগুলির বিরুদ্ধে যৌথ মঞ্চ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ১২দফা সর্বসম্মত দাবির ভিত্তিতে এই মঞ্চের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে স্মারকলিপিও জমা দেওয়া হয়েছে।

১৯৯১সাল থেকে মোট ১৬টি সাধারণ ধর্মঘটে ১৭দিন দেশ স্তব্ধ হয়েছে। গতবছর ২রা   সেপ্টেম্বর বি এম এস শেষ মূহুর্তে প্রত্যাহার করলেও দেশের ১৫কোটি শ্রমজীবী মানুষ এই ধর্মঘটে অংশ নেন, যাদের অনেকেই কোনো ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য নন।

মোদী সরকার গত সাধারণ ধর্মঘটের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘সংস্কার’ আরও ত্বরান্বিত করেছে। এরমধ্যে ‘ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট’ সাম্প্রতিকতম, যা বাজপেয়ী সরকারের সময় আনা হলেও বামপন্থীদের চাপে প্রথম ইউ পি এ সরকার প্রত্যাহার করেছিল।

এই পরিস্থিতিতে, নয়া উদারবাদী নীতির ২৫ বছরে আগামী ২রা সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও জাতীয় স্তরের কর্মচারী ফেডারেশনগুলি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।  শ্রমিকশ্রেণী পুঁজিপতি গোষ্ঠীর নামিয়ে আনা এই আক্রমণের মুখের মতো জবাব দিতে তৈরি হচ্ছে।  

No comments:

Post a Comment