20160905

৩১শে আগস্ট দিকে দিকে শহীদ দিবস পালন করুন-গণ-আন্দোলন গড়ে তুলুন

মানবেশ চৌধুরী

(নতুন প্রজন্মের অনেক কমরেড ১৯৫৯ সালের ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের বিষয়ে কম জানেন। মূলত তাঁদের জন্য ঘটনাগুলি সাজিয়ে দিলাম।)

১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হবার পর কেন্দ্রে ও রাজ্যে যাদের হাতে শাসনভার আসে, তারা হলো দেশী-বিদেশী পুঁজিপতি ও গ্রামীণ জমিদারজোতদারদের তল্পিবাহক। তাদের তোষন করার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে দেশে খাদ্য সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
১৯৫৯ সাল ছিল একটা ঘটনাবহুল বছর, এই বছরে খাদ্য সংকট চরমে ওঠে। খোলা বাজার থেকে চাল, গম প্রভৃতির মতো অনেকগুলি অত্যাবশ্যক দ্রব্য উধাও হয়ে যায় এবং বহু গ্রামে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হয়। 
শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী জনসাধারণের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। তাঁরা খাদ্যের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং লাগাতার গণ আন্দোলন ও গন-বিক্ষোভ প্রদর্শণের রাস্তা গ্রহণ করেন। জনসাধারণের দাবিগুলি সহানুভুতির সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করার পরিবর্তে তখনকার পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সরকার বিক্ষোভকারীদের উপর নির্মম দমন-পীড়ণের রাস্তা গ্রহণ করে।
জনসাধারন চেয়েছিলেন সস্তা দরে তাঁদের প্রয়োজনের খাদ্য পরিবর্তে পেলেন তাঁরা লাঠি, কাঁদানে গ্যাস এবং বুলেট।
১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলন পরিচালনা করে বামপন্থী দলগুলি ও গণ সংগঠন সমুহ। মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধগঠন করে এই আন্দোলন গড়ে তোলা হয়।
১৯৫৯ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি বিধান সভায় দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় প্রথম পর্যায়।
১৫ই জুন কংগ্রেস সরকারের খাদ্য নীতির প্রতিবাদে কলকাতায় প্রথম কেন্দ্রীয় সমাবেশ সংগঠিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে জেলায় জেলায় চলতে থাকে বিক্ষোভ সমাবেশ।
২৫ শে জুন পালিত হয় রাজ্যব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল।
১৩ ই জুলাই শুরু হলো জেল ভরো আন্দোলন। এক মাসের মধ্যে ১৬৩৪ জন গ্রেপ্তার হলেন।
৮ই আগস্ট অনুষ্ঠিত হলো খাদ্য কনভেনশন।
এতো ঘটনার পরেও বধির সরকারের ঘুম ভাঙ্গলো না।
এই পরিস্থিতিতে ১৭ ই আগস্ট বামপন্থী দল ও গণ সংগঠন সমুহের ঐ মঞ্চ –‘মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটিঘোষণা করল ২৩ আগস্ট থেকে সারা পচ্ছিমবঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে খাদ্যের দাবিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করা হবে।
এই ঘোষণায় জনবিরোধী কংগ্রেসী সরকার আতঙ্কিত হয়ে উঠল এবং এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য এলাকায় এলাকায় হিংসার পরিকল্পনা গ্রহণ করল। কিন্তু খাদ্যের ব্যবস্থা করলো না! বড়লোকদের দল তার শ্রেণীর স্বার্থ দেখা শুরু করলো।
২৩শে আগস্ট থেকে শুরু হলো খাদ্য আন্দলনের দ্বিতীয় পর্যায়।
২৬ শে আগস্ট মাঝরাতে বামপন্থী নেতা ও কর্মীদের ধড়পাকড় ও ঘরে ঘরে খানাতল্লসী শুরু হলো। দুই সপ্তাহে মোট ২৬৩৪ জনকে সরকার গ্রেপ্তার করলো।
কিন্তু বামপন্থী নেতা ও কর্মীদের উপর দমনপীড়ণের প্রতিবাদে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠলেন। কলকারখানা-হাটে-বাজারে, মহল্লায়, গঞ্জে সর্বত্র মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রতিবাদে শামিল হলেন। কারন, লড়াইটা তো তাঁদেরই জন্য তাঁদেরই লড়াই।
কংগ্রেস সরকারের দমন-পীড়ণ সত্বেও ২৩শে আগস্ট থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় পর্যায়ের খাদ্য আন্দোলন দমন করা সম্ভব হলো না। সাধারন মানুষও গ্রেপ্তার হতে শুরু করলেন। ২৭ শে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৭০০০ জন নর-নারী গ্রেপ্তার হলেন। 
৩১ শে আগস্ট খাদ্যমন্ত্রীর অপসারণ ও খাদ্যের দাবিতে এবং পুলিশি দমন-পীড়নের প্রতিবাদে কলকাতার শহীদ মিনার ময়দানে লক্ষ লক্ষ নরনারীর জমায়েত হলো। মহাকরণ অভিমুখে চলমান শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ লাঠি চালায়। সহস্রাধিক মানুষ পুলিশের আক্রমণে আহত হলেন। সাধারণভাবে বলা হয় ৮০ জন, কিন্তু কয়েকশত মানুষ ঐ বর্বর আক্রমণে মারা যান। শেষ রাতে প্রচুর মৃতদেহ পাচার করে দেয় সরকারী বাহিনী। 
ঐদিন গঙ্গারামপুর, বর্ধমান, বহরমপুর ও মেদিনীপুরেও পুলিশ লাঠিচার্জ করে।
শুরু হলো খাদ্য আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল কংগ্রেসী সরকারের এই বর্বরতার কাহিনী।
১লা সেপ্টেম্বর পুলিশের লাঠি চালনা ও হিংস্র তাণ্ডবের বিরুদ্ধে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হলো। এই ধর্মঘটি ছাত্রদের উপরেও পুলিশ আক্রমণ করে লাঠি চার্জ করে, গুলি চালায়। কলকাতার বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বেপরোয়া গুলি চালনার ফলে ৮ জন নিহত ও ৭৭ জন আহত হলেন।
এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৩রা সেপ্টেম্বর পালিত হলো সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল। সেদিনও রাজ্যের বভিন্ন স্থানে গুলি চললো। মারা গেলেন ১২ জন এবং আহত হলেন ১৭২ জন। গ্রেপ্তার করা হলো নির্বিচারে।
কংগ্রেস সরকার কালোবাজারী ও মুনাফাখোরদের স্বার্থে, এভাবে শত শত নিরপরাধ শান্তিপ্রিয় নর-নারীর উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে থাকলো।
কিন্তু এতো অত্যাচার সত্বেও মানুষের প্রতিবাদ স্তব্ধ করা গেল না। মানুষ খাদ্যের দাবিতে আরও উত্তাল হয়ে উঠলেন।
৮ই সেপ্টেম্বর সারা রাজ্যে পালিত হলো ছাত্রদের ডাকে শহীদ দিবস। 
রক্তস্নাত কলকাতার বুকে ১০ই সেপ্টেম্বর সংগঠিত হলো অবিস্মরণীয় মৌন মিছিল। হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড হত্যাকাণ্ডের প্রকাশ্য তদন্ত চাই, খাদ্য মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। ১৮৫৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।
১৯শে সেপ্টেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লনে শহীদ স্তম্ভ বানানো হলো। 
২৪শে সেপ্টেম্বর সত্যাগ্রহ পালান করলেন নানা সংগঠন।
২৬শে সেপ্টেম্বর কলকাতা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে শহীদ স্তম্ভ নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হলো। 
সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, ব্যাপ্তি ও সংঘর্ষের বিচারে ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিরাট। 
বামপন্থী দল ও গণসংগঠনসমূহ ঠিক করলো, প্রতি বছর ৩১শে আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হবে।
পরে ঠিক হয়, শুধু খাদ্য আন্দোলনের শহীদ নন, সকল শহীদের স্মরণেই ৩১শে আগস্ট শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হবে। এবং সে ভাবেই হয়ে আসছে।
শুধু শহীদদের স্মরণ করা নয়, কঠিন কঠোর লড়াইয়ের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করার শপথ নেবার দিন ৩১শে আগস্ট।
প্রতিবছরই এই শহীদ দিবসটি খাদ্যের দাবির লড়াইয়ের বিষয় সহ লড়াইয়ের ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। এবারও তাই ই হয়েছে।

(যাঁরা বলবেন তাঁদেরকে বর্তমান সময়ের বিষয়গুলি অতঃপর ব্যাখ্যা করতে হবে।)
 

No comments:

Post a Comment