ড. অসীম দাশগুপ্ত
কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাঙ্কের
মুখ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কৌশিক বসু কলকাতায় একটি সংবাদপত্রের প্রতিনিধিকে হঠাৎই
বলেছেন, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে নাকি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি হয়েছে! যেহেতু আর কিছুই নির্দিষ্টভাবে
বলা নেই, তাই আলোচনার জন্য আমরা ধরে নিচ্ছি, বলার চেষ্টা হয়েছে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই — কৃষি,
শিল্প, পরিষেবা, পরিকাঠামো,
জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই
বামফ্রন্টের আমলে ক্ষতি হয়েছে। আমরা এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেরই প্রকৃত তথ্যগুলি পেশ
করছি, এবং লক্ষ্য করছি, তার থেকে
কিন্তু উঠে আসছে অন্য একটি চিত্র। এই তথ্যগুলির উৎস হলো প্রধানত ভারত সরকার এবং
রাজ্য সরকারের প্রকাশিত রিপোর্টসমূহ।
কৃষিতে প্রকৃত তথ্য
প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের শুরুর
বছর (১৯৭৭-৭৮) থেকেই কৃষির ক্ষেত্রে ভূমি সংস্কারের ওপর বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান
করার পাশাপাশি, সেচের সম্প্রসারণ, উন্নত বীজ ও সারের ব্যবহার এবং এই
সকল বিষয়ে নির্বাচিত পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এলাকার মানুষদের যুক্ত করার ফলে কৃষিতে
উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক ধারাবাহিক বৃদ্ধিই পরিলক্ষিত হয়। বামফ্রন্ট সরকারে আসার
আগের বছরে (১৯৭৬-৭৭), রাজ্যে চালের মোট উৎপাদন ছিল ৫৯ লক্ষ
মেট্রিক টন, এবং তখন পশ্চিমবঙ্গ ছিল চালের ক্ষেত্রে ঘাটতি
রাজ্য। কিন্তু ভূমি সংস্কারকে ভিত্তি করে এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করার ফলে চালের
উৎপাদন ধাপে ধাপে ১০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে শেষ বছরগুলিতে গড়ে ১৪০ লক্ষ
মেট্রিক টনে পৌঁছায় এবং চালের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ উন্নীত হয় উদ্বৃত্ত রাজ্যে,
এবং চালের উৎপাদনে সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয়
সর্বপ্রথম। আলুর ক্ষেত্রে এ-রাজ্যের মোট উৎপাদন চমক সৃষ্টি করেই ১৯৭৬-৭৭ সালে ১৭
লক্ষ মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে সপ্তম বামফ্রন্টের শেষ বছরে (২০১০-১১) ১০০ লক্ষ
মেট্রিক টনকে অতিক্রম করে, এবং দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের
স্থান হয় দ্বিতীয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০১০-১১ সালে
এ-রাজ্যে সামগ্রিকভাবে সবজির মোট উৎপাদন হয় ১৩০ লক্ষ মেট্রিক টনেরও বেশি, এবং এই মোট সবজির উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান হয় সর্বপ্রথম। এর সঙ্গে
ধারাবাহিকভাবে অগ্রগতি হয় উদ্যান চাষ, মৎস্য চাষ এবং
প্রাণীসম্পদ বিকাশের ক্ষেত্রে। ’৮০-র দশকেই মৎস্য উৎপাদনে
সমগ্র দেশে এ-রাজ্য প্রথম স্থান অধিকার করে। বনায়নের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সামাজিক বনসৃজনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয় প্রথমসারিতে
এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষদের যুক্ত করে বনরক্ষার সাফল্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গ লাভ করে
আন্তর্জাতিক সম্মান (পল গেটি পদক)।
ভূমি সংস্কার থেকে শুরু করে এই
প্রত্যেকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে, কৃষি এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলিতে
শুধুমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধি পায় তাই নয়, খেতমজুরদের মজুরির হারও,
শুধু টাকার অঙ্কে নয়, মূল্যবৃদ্ধি ধরেও
অধিকাংশ সময়েই প্রকৃত অর্থেই বৃদ্ধি পায়। যেহেতু ভূমি সংস্কারের কারণে কৃষিতে এই
উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটেছে সাধারণ কৃষকদের জমিতেই, তাই তাঁদের আয়
এবং ক্রয় ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় ধারাবাহিকভাবেই। এর প্রতিফলন ঘটেছে তাঁদের
শিল্পপণ্যের চাহিদার বৃদ্ধিতেও। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, জাতীয়
নমুনা সমীক্ষার (৬৯তম রাউন্ডের) তথ্যাবলির ভিত্তিতেও দেখা যায় যে, ২০১০-১১ সালে এ-রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের শিল্পপণ্যের চাহিদা
বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকায়।
শিল্প এবং পরিষেবার প্রকৃত তথ্য
শিল্পপণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজারের
এই ক্রমবর্ধমান বিকাশ,
ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা, দক্ষ শ্রমিক ও
প্রযুক্তিবিদদের অবস্থান এবং বামফ্রন্ট সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি — এই কারণগুলিই এরাজ্যে শিল্পোন্নয়নের বস্তুগত ভিত্তি স্থাপন করেছে। এছাড়া,
কেন্দ্রীয় সরকারের মাসুল সমীকরণের নীতি এবং লাইসেন্স প্রদানের
বৈষম্যমূলক নীতি যা এরাজ্যের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বারংবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
করেছে, তা ’৯০-র দশক থেকে কিছুটা
প্রত্যাহৃত হওয়ায় শিল্পস্থাপনের ক্ষেত্রে তারও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই সামগ্রিক
কারণগুলিরই প্রতিফলন ঘটেছে শিল্প বিকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে — বৃহৎ শিল্প, মাঝারি শিল্প, ক্ষুদ্র
শিল্প এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠী স্থাপন — এই প্রত্যেকটি
ক্ষেত্রেই।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৯১ সাল থেকে
২০১০ সাল পর্যন্ত সময়কালে (যে সময়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে
হলদিয়াপেট্রোরসায়ন প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে এবং ঘোষিত হয়েছে ১৯৯৮ সালের বামফ্রন্ট
সরকারের শিল্পনীতি) এ-রাজ্যের সংগঠিত বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে মোট ২,৫৩১টি শিল্প সংস্থায় শুধুমাত্র প্রস্তাবিত বিনিয়োগ নয়, কারখানাগুলি চালু হয়ে উৎপাদনও শুরু করে বাস্তবায়িত হয়েছে ৬৫,৬৮৬ কোটি টাকার প্রকৃত বিনিয়োগ, এবং প্রত্যক্ষ
কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২.৯৮ লক্ষ জনের (এবং এর অন্তত দ্বিগুণ সংখ্যক সৃষ্টি
হয়েছে পরোক্ষ কর্মসংস্থান)। উল্লেখনীয় যে, এই শুরু হওয়া
শিল্প সংস্থাগুলির মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই হলো মাঝারি শিল্প সংস্থা। আরও লক্ষণীয় যে,
এই সময়কালে শুধুমাত্র শেষ বছরেই (২০১০ সালে) স্থাপিত হয়েছে ৩২২টি
নতুন শিল্প সংস্থা এবং এখানে বাস্তবায়িত বিনিয়োগের পরিমাণ হয়েছে ১৫,০৫২ কোটি টাকা। প্রধানত যে শিল্পগুলিতে বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলি হলো খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, লোহা ও ইস্পাত,
রসায়ন ও পেট্রোরসায়ন এবং তথ্য প্রযুক্তি।
বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে, শিল্পের
ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য স্থানে উঠে এসেছে রাজ্যের ক্ষুদ্রশিল্প
সংস্থাগুলি। এই বিষয়ে ভারত সরকারের নমুনা সমীক্ষার (২০০৫-০৬) তথ্য অনুযায়ী
ক্ষুদ্রশিল্পের সংখ্যা (এরাজ্যে ২৭.৫৯ লক্ষ) এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি (এ রাজ্যে
৫৪.৯৩ লক্ষ), উভয় ক্ষেত্রেই সমস্ত রাজ্যকে অতিক্রম করে
পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয়েছে সর্বপ্রথম।
পরিষেবার ক্ষেত্রেও ভারত সরকারের
জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে (২০০৯)। এই গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষার
তথ্যাবলি থেকেও দেখা যাচ্ছে, পরিষেবার ক্ষেত্রে এরাজ্যের পরিষেবা সংস্থার সংখ্যা
২০০৬-০৭ সালে হয়েছে প্রায় ২০ লক্ষ এবং এক্ষেত্রে রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের
স্থান হয়েছে দ্বিতীয়।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সাধারণ
উদ্যোগীদের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা
সৃষ্টি করেছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি। এ-রাজ্যে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সংখ্যা
২০১০-১১ সালে পৌঁছায় ১৪.৭০ লক্ষে (যাঁদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগই হলো মহিলা গোষ্ঠী)
এবং এই গোষ্ঠীগুলির সদস্যা/সদস্য সংখ্যাও অতিক্রম করে ১ কোটিকে।
পরিকাঠামোর ক্ষেত্র
যেহেতু কৃষিতে ও শিল্পে উৎপাদন
বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন সাধারণ পরিকাঠামোর, তাই বামফ্রন্ট সরকার, তার ক্ষমতার মধ্যে দাঁড়িয়ে, ধারাবাহিকভাবেই পদক্ষেপ
গ্রহণ করেছে সেতু, উড়াল পুল, রাস্তা
এবং বিদ্যুতের উন্নতির ক্ষেত্রে। এর মধ্যে সেতু এবং উড়াল পুলের ক্ষেত্রে পূর্ত ও
পূর্ত (সড়ক) দপ্তর একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম চার বছরে (২০০৭-১১) মধ্যেই
৪৭টি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। রাস্তার ক্ষেত্রেও এই চার বছরের মধ্যে
শেষ হয় প্রায় ৪,১০৯ কিলোমিটার রাস্তার উন্নয়নের কাজ। এর
পাশাপাশি বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৫৮,২৭৪
কিলোমিটার রাস্তার উন্নয়নের দায়িত্ব ত্রি-স্তর পঞ্চায়েত এবং ১৪,৮৯৮ কিলোমিটারের রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব বহন করে পৌর
সংস্থাগুলি।
বিদ্যুতের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা
প্রয়োজন যে, ১৯৭৭ সালে রাজ্যে ব্যাপক বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
বামফ্রন্ট সরকার প্রথম বছর থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল সুষ্ঠু পরিকল্পনার
ভিত্তিতে ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার সংযোজন করা এবং রাজ্য সরকারের অধীন
বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির অভ্যন্তরীণ দক্ষতা বৃদ্ধি করার। এর ফলে, বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিতে উৎপাদন ক্ষমতা ১৯৭৬-৭৭ সালে ১,৬১৫
মেগাওয়াট থেকে লক্ষণীয়ভাবে ৫০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০-১১ সালে পৌঁছায় ৯,৯৭৪ মেগাওয়াটে, এবং অভ্যন্তরীণ দক্ষতার মাপকাঠি
হিসেবে প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর ১৯৭৬-৭৭ সালে ৩৩ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি
পেয়ে ২০১০-১১ সালে পৌঁছায় প্রায় ৭১ শতাংশে। এর ফলে, শুধু যে রাজ্যে
বিদ্যুতের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য অর্জিত হয় তাই নয়, রাজ্য সরকারের অধীন বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির লাভও ২০১০-১১ সালে প্রায় ৪৬৪.১০
কোটি টাকায় উন্নীত হয়ে সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যেই এক নজির স্থাপন করে।
জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্র
সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়
বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন-সহায়ক সাধারণ পরিকাঠামোর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয়
সামাজিক পরিকাঠামোর,
বিশেষ করে, জনস্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থারও
ধারাবাহিক উন্নতির।
জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে
বামফ্রন্ট সরকারের তরফ থেকে জোর দেওয়া হয় বিকেন্দ্রীকৃত নিবারণমূলক চিকিৎসার ওপর, এবং নিরাময়মূলক
চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় বিকেন্দ্রীকরণের ওপর। এই লক্ষ্যে যেখানে সম্ভব
স্বাস্থ্য দপ্তরের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত করা হয় পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলির উদ্যোগও।
এর ফলে, ভারত সরকারের রাজ্যওয়াড়ি তথ্যাবলি (উৎস: এস আর এস,
স্বাস্থ্য মন্ত্রক, ভারত সরকার) অনুযায়ী
পশ্চিমবঙ্গে হাজার প্রতি মৃত্যুহার ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়ে ২০১০ সালে হয়েছে ৬.০,
যা শুধু সর্বভারতীয় মৃত্যু হারের (৭.২) থেকে অনেক কম তাই নয়,
সমস্ত প্রধান রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা কম। হাজার প্রতি
শিশুমৃত্যুর হারও এরাজ্যে ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৩১, যা
সর্বভারতীয় হারের (৪৭) থেকে পুনরায় অনেক কম, এবং সাফল্যের
দিক থেকে প্রধান রাজ্যগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থানে।
শিক্ষার ক্ষেত্র
শিক্ষার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট
সরকার যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে এগিয়েছে তা হলো, শিক্ষার সুযোগ
সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করা এবং
সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাকে সমন্বিত করা, যাতে সামগ্রিকভাবে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাকে প্রয়োগ করতে পারে কর্মসংস্থান ও
উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে।
সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েদের
কাছে শিক্ষার সুযোগ সহজে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে, প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকেই
বিদ্যালয়স্তরে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে করা হয় অবৈতনিক এবং সরকারের
সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিটি মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও ধার্য করা হয়
অপেক্ষাকৃত স্বল্প ফি। এর পাশাপাশি বামফ্রন্ট সরকারের তরফ থেকে মাননীয়
শিক্ষক-অধ্যাপকদের মর্যাদা প্রদানের অঙ্গ হিসেবেই বহন করা হয় তাঁদের বেতন ও
অবসরকালীন সুবিধা প্রদানের মূল দায়িত্ব।
অগ্রাধিকার আরোপ ও এই আর্থিক
দায়িত্বভার গ্রহণ করার ফলে এ-রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার সুযোগ প্রাসঙ্গিক
বয়সসীমার (৫+ থেকে ৮+) মধ্যে সমস্ত শিশুর কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার নিট অনুপাত ধাপে ধাপে উন্নীত হয়ে ২০১০-১১ সালে পৌঁছায় ৯৯
শতাংশে।
শুধুমাত্র বিদ্যালয়ে ভর্তি করা
নয়, ছাত্রছাত্রীদের
মধ্যে বিদ্যালয়-ছুটের অনুপাতও যাতে হ্রাস পায় তার জন্য জোর দেওয়া হয় দুপুরে রান্না
করে খাওয়ানোর কর্মসূচির সম্প্রসারণ এবং নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের ওপর। মহিলা
স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের যুক্ত করে, দুপুরে রান্না করে খাওয়ানোর
কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হয় ৯৬.৫ শতাংশ বিদ্যালয়কে। এছাড়া, নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের ক্ষেত্রে, ২০০৯-১০ এবং
২০১০-১১ সালে প্রাথমিক স্তরে নিযুক্ত করা সম্ভব হয় ৪৯,১৬১ জন
এবং উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ২৬,৬০৮ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। এর ফলে প্রাথমিক স্তরে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত
হ্রাস পেয়ে ২০১০-১১ সালে পৌঁছায় ৩১.৫ : ১-এ। এই পদক্ষেপগুলির ফল হিসেবে প্রাথমিক
স্তরে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়-ছুটের অনুপাত ২০১০-১১ সালে হ্রাস পেয়ে হয় ৪.৫ শতাংশ,
এবং প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয়- ছুটের এই অনুপাত হ্রাস পাওয়ার ইতিবাচক
প্রভাব হিসেবে উচ্চ-প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তির অনুপাতও বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০-১১-তে
দাঁড়ায় ৮৯.৬ শতাংশে। এছাড়া, উচ্চ-প্রাথমিক
স্তরেও বিদ্যালয়-ছুটের অনুপাত দাঁড়ায় ৫.৪ শতাংশে। শিক্ষার ক্ষেত্রে এই উন্নতির
সামগ্রিক ফল হিসেবে এ-রাজ্যে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষার্থীদের
সংখ্যাও বৃদ্ধি পায় ধারাবাহিকভাবে। এই উদ্যোগগুলির সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয়
পঠন-পাঠনের উন্নতির ওপর, বিশেষ করে বিদ্যালয় ভিত্তিক
মাতা-শিক্ষক সমিতি এবং বিদ্যালয় পরিদর্শনের কাজকর্মের ক্ষেত্রে। এই পদক্ষেপগুলির
ফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে, জাতীয় শিক্ষা গবেষণা পর্ষদের (NCERT) প্রকাশিত
রাজ্যওয়াড়ি তথ্যাবলি (২০০৮) অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির শেষে ছাত্রছাত্রীদের গণিত ও
ভাষা জ্ঞানের মূল্যায়নে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সমগ্র দেশে হয়েছে দ্বিতীয়।
শিক্ষার সুযোগের সম্প্রসারণ এবং
মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যাতে ছাত্রছাত্রীদের উৎপাদনে অংশগ্রহণ ও কর্মসংস্থানের
সুযোগ বৃদ্ধি হয়, তার জন্য বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা প্রসারের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা
হয়। এর ফলে রাজ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্ষেত্র/প্রতিষ্ঠান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে
২০১০-১১ সালে পৌঁছায় ৩,১৮৬-তে এবং এই
ক্ষেত্র/প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় প্রায় ৩.১১ লক্ষ ছাত্রছাত্রী।
একই দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করে
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও শিক্ষার সুযোগের সম্প্রসারণের সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয়
কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির ওপর, এর ফলে রাজ্যে মোট মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যা
দাঁড়ায় ৪৫৪-তে এবং কারিগরি/পেশাদারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান/বিভাগের সংখ্যা ৪১৪-তে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও উন্নীত হয় ২০-তে। গুণমানের দিক থেকে উল্লেখ করা প্রয়োজন
যে, উৎকর্ষের নিরিখে সর্বভারতীয় স্তর থেকে চিহ্নিত হয়
রাজ্যের ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৭টি মহাবিদ্যালয়।
এর পাশাপাশি সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও
মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার মূল অগ্রাধিকার আরোপ করে শিক্ষার
প্রসারে পরিকাঠামোর উন্নতি,
প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ওপর। একইভাবে,
অনগ্রসর শ্রেণির কল্যাণের ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়
শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং কর্মসংস্থানমুখী ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে।
শিক্ষার প্রতিটি স্তরে সুযোগের
সম্প্রসারণ ও পঠন-পাঠনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বজায় রাখার চেষ্টা হয়েছে, বিশেষ গুরুত্ব
দিয়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে উপযুক্ত গণতান্ত্রিক
কাঠামো ও পরিবেশ।
বিকেন্দ্রীকরণ
প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ
ক্ষেত্রে, নির্বাচিত পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির মাধ্যমে স্থানীয় মানুষদের যুক্ত করে
বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকেই, এবং এই উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয়ও করা হয় বিভিন্ন দপ্তরের উদ্যোগকে জেলা
পরিচালনা কমিটি এবং ব্লক পরিচালনা কমিটিগুলির মাধ্যমে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,
১৯৮৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের
সমস্ত রাজ্যগুলির পঞ্চায়েতী রাজ সম্মেলনের উদ্বোধন করতে এসে তদানীন্তন
প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে
বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগের প্রশংসা করে তাকে সমগ্র দেশের মডেল হিসেবেই চিহ্নিত
করেন। এই ধারণাকে সামনে রেখেই পরে (১৯৯২) পঞ্চায়েত এবং পৌর সংস্থাগুলির মাধ্যমে
বিকেন্দ্রীকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংশোধনও (যথাক্রমে ৭৩তম এবং ৭৪তম
সংশোধন) করা সম্ভব হয়। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, ভারত
সরকারের পঞ্চায়েতী রাজ মন্ত্রকের রাজ্যওয়াড়ি পর্যালোচনার (২০০৯-১০) প্রকাশিত ফল
অনুযায়ী, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণের নিরিখে
সমস্ত দেশের মধ্যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই পশ্চিমবঙ্গ অর্জন করে প্রথম
স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সম্মান।
দারিদ্র্য হ্রাস ও কর্মসংস্থান
বৃদ্ধি
এই সামগ্রিক উদ্যোগের ফলে
এ-রাজ্যে বামফ্রন্টের আমলে শুধু যে কৃষি, শিল্প, পরিষেবা,
পরিকাঠামো, জনস্বাস্থ্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে
ধারাবাহিকতার উন্নতি পরিলক্ষিত হয় তাই নয়, এই উন্নতির
প্রভাবে দ্রুততার সঙ্গে হ্রাস পায় দারিদ্র্যের অভিঘাতও। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় যোজনা
আয়োগের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে সামগ্রিকভাবে
দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার অনুপাত ১৯৭৭-৭৮ সালে ৬০.৫ শতাংশ থেকে
২০০৪-০৫ সালে লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২০.৬ শতাংশে। এর পাশাপাশি
কর্মসংস্থানের ওপর জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য (২০০৯-১০) থেকেও দেখা যাচ্ছে যে,
যেখানে ১৯৯৯-২০০০ সাল এবং ২০০৯-১০ সালের সময়কালের মধ্যে সমগ্র দেশে
প্রধান কাজ এবং দৈনিক কাজের ভিত্তিতে গড় বার্ষিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার হয়েছে
যথাক্রমে ১.৬ শতাংশ এবং ৪.২ শতাংশ, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের
ক্ষেত্রে এই গড় বার্ষিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার থেকেছে অনেক উঁচুতে-যথাক্রমে ২.১
শতাংশ এবং ৪.২ শতাংশে।
* * *
সুতরাং ওপরের আলোচনার মাধ্যমে
প্রকাশিত তথ্যের (যার অধিকাংশই হলো ভারত সরকারেরই তথ্য) ভিত্তিতে আমরা অধ্যাপক
কৌশিক বসুর বক্তব্যটি সমস্ত দিক থেকেই খন্ডন করে প্রমাণ করলাম যে বামফ্রন্টের আমলে
এ-রাজ্যে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ক্ষতি নয়, ধারাবাহিকভাবে
উন্নতিই পরিলক্ষিত হয়েছে, এবং অনেক ক্ষেত্রেই সমস্ত
রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান হয়েছে সর্বোচ্চ স্তরে। তবে শুধু অধ্যাপক
বসু নন, অন্যান্য কিছু ব্যক্তিত্বও মাঝে মাঝেই বিষয়ের গভীরে
প্রবেশ না করে, হালকাভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ-রাজ্যের
ক্ষেত্রে এই ধরনের ভিত্তিহীন বক্তব্য রাখেন। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তথ্যের ভিত্তিতে
তা খন্ডন করে প্রকৃত তথ্যগুলি বারংবার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই হবে। এর
পাশাপাশির কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা থাকলে, তাও
স্বচ্ছতার সঙ্গে আলোচনা করে কিভাবে তা অতিক্রম করতে চাইছি তাও মানুষের কাছে বলতে
হবে, তাঁদের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে।
No comments:
Post a Comment