20160905

মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গুর উৎসব আসলে জমি হাঙরদের সহর্ষ আস্ফালন

সূর্য মিশ্র

বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে সিঙ্গুরে টাটা মোটর্সের গাড়ি কারখানা তৈরির জন্য যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এতই আনন্দিত হয়েছেন যে তিনি রাজ্যজুড়ে সিঙ্গুর উৎসব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর দলবল গ্রামে, শহরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে উৎসবের আয়োজন করেছে। শিক্ষামন্ত্রী আরো একধাপ এগিয়ে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যসূচীতে সমগ্র বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এইসবের পিছনে আসলে মনে হচ্ছে রাজ্যবাসীর পয়সায় রাজ্যে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে।

এতকিছু করলেও বিষয়টির কিন্তু শেষ ঘটে যায়নি। এখনো কফিনের শেষ পেরেক পোঁতা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় দুই বিচারপতি সিঙ্গুরের জমি নিয়ে মোট ৯টি বিষয়কে বিবেচনার জন্য নির্ধারণ করে।  বিচারপতিদের মোট ২০৪ পৃষ্ঠার রায়ের ৭২-৭৩ পৃষ্ঠায় এই বিষয়গুলিকে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই ৯টি বিষয়ের মধ্যে মাত্র ৩টি বিষয়ে দুই বিচারপতি সহমত হয়েছেন। ২০৪ পৃষ্ঠার রায়ে মতৈক্যের অংশ মাত্র দেড় পৃষ্ঠার মতন (১০৫-১০৬ পৃষ্ঠা)। এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের সুযোগও রাখা রয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ বাতিল করার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে যে মামলা হয়েছিল, হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ২০০৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি একটি রায়ে তা খারিজ করে দিয়েছিলকিন্তু সিঙ্গুর সংক্রান্ত অন্যান্য মামলাগুলির এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, সেগুলি এখনো বিচারাধীন। যেমন, ২০১১ সালে রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরে মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরানোর যে বিল এনেছিলেন তা কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ খারিজ করে দেয়। সেই বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতিও পায়নি। সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায়ে এই বিলের কথা উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু তা এখানে বিচার্য হয়নি। ২০১১ সালে বিধানসভায় এই বিল আনার সময়েই আমরা বলেছিলাম, এই বিল অসাংবিধানিক, এটা আটকে যাবে। সরকারকে সতর্ক করে আমরা বলেছিলাম যে জমি ফেরাতে চাইলে ইচ্ছুক এবং অনিচ্ছুকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করবেন না। যেহেতু তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার থাকতে সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা তৈরি হওয়ার আর কোনো বাস্তবতা ছিল না, সেই কারণে আমরা ইচ্ছুক অনিচ্ছুক নির্বিশেষে সবাইকে জমি ফেরৎ দেওয়ার জন্য বলেছিলাম এবং সরকারকে এরজন্য একটি বিকল্প প্রস্তাবও দিয়েছিলাম যা সংবিধান ও আইনসম্মত ছিলসুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায় থেকে এটা স্পষ্ট যে তৃণমূল সরকারের আনা সিঙ্গুর বিল মাফিক অনিচ্ছুকদের জমি ফেরতের কোনো সুযোগ নেই, ঐ বিল এখন বিশ বাঁও জলে।

তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর এই উৎসব পালনের কারণ কী? এটা ওঁর বিরাট জয়? আর পূর্বতন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের বিরাট পরাজয়? সিঙ্গুরের সব মামলার জল কোথা থেকে কোথায় গড়ায় তার তোয়াক্কা না করেই মুখ্যমন্ত্রী এখন উৎসবের আয়োজন করেছেন। সিঙ্গুর নিয়ে একশো আশি ডিগ্রি ভোল বদলে এখন অনেকেই অনেক কিছু বলছেন। তখন তাঁরা কে কী বলেছিলেন তার বিস্তারিত উল্লেখ এখানে কুলোবে না। অতএব যে যা বলতে চান বলুনকিন্তু আমরা গিরগিটি নই, কোনো মৌলিক বিষয়ে ওরকমভাবে ঘন ঘন অবস্থান বদলানো আমাদের কাজ নয়।

আমাদের অবস্থান কর্মসংস্থানের স্বার্থে শিল্পায়নের পক্ষে। কৃষি আমাদের ভিত্তি, তাকে শক্তিশালী করে পৃথিবীর যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের মতোই আমাদের দেশ ও রাজ্যকেও কর্মসংস্থানমুখী শিল্পায়নের দিকে যেতে হবে। কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ, এর কোনো বিকল্প নেই। সিঙ্গুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায়ের পরে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পের ‘ডেস্টিনেশন’ হবে। যার রাজত্বে রাজ্যে কৃষিতে সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে, কৃষকের আত্মহত্যা ঘটে চলেছে, চা বাগান, চটকল থেকে শুরু করে হিন্দমোটরসহ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পগুলির অন্তর্জলি যাত্রা প্রতিদিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে, তিনি ছাড়া এমন ঘোষণা আর কে করবেন! তাঁর পথ বি-শিল্পায়নের পথ। সারদা-নারদা, সিন্ডিকেট, তোলাবাজি, জমির দালালি আর মাফিয়াবৃত্তির পথ, পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের পথ। ক্রমবর্ধমান বেকার বাহিনীকে লুম্পেনবৃত্তির দিকে ঠেলে দেওয়ার পথ। সমাজের বুকে এর মারাত্মক ফলাফল আমরা ঘনঘন দেখতে পাচ্ছি। অতি সম্প্রতি কলকাতায় এক কিশোরীকে গাড়িতে তুলে ধর্ষণ করে খুনের যে বীভৎস ঘটনা ঘটেছে, সেটাও এই পথেরই ফলাফল। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এতে উদ্বিগ্ন নন, তিনি মনে করছেন, এইসব নিয়েই উৎসব হবে।

বামফ্রন্ট সরকার সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ করেছিল কর্মসংস্থানমুখী শিল্পায়নের জন্য, কৃষির ওপরে চাপ কমানোর জন্য এবং কৃষিতে আরো বিনিয়োগ বাড়িয়ে তাকে শক্তিশালী করার জন্য। শিল্পায়ন মানে কী? আমরা বুঝেছিলাম, শিল্পায়নের পথ মানে বৃহৎ, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্পের আনুপাতিক ভারসাম্য ও সমন্বয় বজায় রেখে এগোনো। কোনো একটাকে বাদ দিয়ে কেবল আরেকটাকে নিয়ে এগোনো যায় না। অযথা সময় নষ্ট না করেও কৃষিজমির মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলিতে সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রেখে, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি প্রত্যেকটি বিষয়ে সচেতন থেকে অগ্রসর হওয়া। এসবের মধ্যে কোথাও কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটেনি বা ঘটবে না, এমন দাবি করা অবাস্তব। কিন্তু বর্তমান সরকার তো আইন সংবিধান কিছুই মানে না। শিল্পক্ষেত্রে সমন্বয়, ভারসাম্য এসব তো এই সরকারের কাছে অনেক দূরের কথা। এই সরকার নৈরাজ্যের উৎস এবং উৎসবের সরকার।

সিঙ্গুরের জমি নিয়ে মামলা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে। অধিগ্রহণের সময় থেকে সুপ্রিম কোর্টে মামলার সময়ের মধ্যে সরকার বদলে গেছে। তাই মামলাতেও সরকারেই হারতে হবে- এটাই ছিল সরকারের মনোভাব। মামলা চলাকালীন আদালতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য দাখিল করা হবে কিনা, তথ্য আড়াল করা হবে কিনা, এসব সরকারের সদিচ্ছার ওপরে নির্ভর করে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল কী হবে সেসব বিবেচনা না করে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থপূরণ হতে পারে, রাজ্যের জনগণের সামগ্রিক স্বার্থপূরণ হবে না। মুখ্যমন্ত্রী যে বিমানবন্দরের উদ্বোধন করেছেন (যদিও এরমধ্যেই সেটা বন্ধ হয়ে গেছে), সেখানকার জমিও যদি সিঙ্গুরের মতো একই কায়দায় ফেরতের দাবি ওঠে তখন কী হবে?

১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন যে কৃষকদের স্বার্থরক্ষার পক্ষে যথেষ্ট নয়, সেই আইনের খোলনলচে যে বদলানো দরকার, সেই দাবি বামফ্রন্ট সরকার ধারাবাহিকভাবে করে এসেছে। শুধু তাই নয়, এই আইনে কৃষক ও বর্গাদারদের স্বার্থবাহী অনেকগুলি সংশোধনীও বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে করা হয়েছিল যা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনও পেয়েছিলকেন্দ্রীয় সরকার এবং অন্যান্য রাজ্যগুলিও বিভিন্ন সময়ে এই জমি অধিগ্রহণ আইনে কিছু কিছু ইতিবাচক সংশোধন করেছিলকিন্তু এটাই ছিল কেন্দ্রীয় আইন এবং ২০১৩ সালের আগে পর্যন্ত ঐ আইনটিই ছিল জমি অধিগ্রহণের একমাত্র আইন। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইন বলবৎ হওয়ার পরেও সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে এমন বলা যাবে না। কারণ আমাদের কাছে মূল প্রশ্নগুলি জমি অধিগ্রহণের লক্ষ্য, নীতি ও অভিমুখ ঘিরে। কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করে শিল্প বা জনস্বার্থবাহী প্রকল্পের জন্য, পরিকাঠামোর জন্য জমি সংগ্রহ করতেই হবে। প্রশ্ন হলো, এতে কি সরকারের কোনো ভূমিকা থাকবে না? সরকারের কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন থাকবে না? কৃষকদের কি জমি হাঙরের মুখে ছেড়ে দেওয়া হবে?

এই প্রশ্নগুলির নিরিখে ভাবতে হবে কী ঘটছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে? এখন কী ঘটছে এরাজ্যে? বামফ্রন্ট সরকারের অধিগ্রহণ করা জমিগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে? সড়ক, বিদ্যুতের সাব-স্টেশন, ইত্যাদি নির্মাণের জন্য এখন কীভাবে কতখানি জমি সংগ্রহ করা হচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে এখন জমি মাফিয়াদের মুখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গুর উৎসবে জমির মাফিয়া, সিন্ডিকেট, প্রোমোটারি বাণিজ্য, বেসরকারী শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলির বাণিজ্যিক মালিকদের সহর্ষ আস্ফালন দেখা যাচ্ছে। সেটা কি নজরে পড়ছে না? নাকি এগুলি উপেক্ষা করার মতো? জমিবাণিজ্য থেকে সুবিধাভোগী এইসব আস্ফালনকারীদের মধ্যে শাসকদলের কেষ্টবিষ্টুরা রয়েছেন, মন্ত্রীসান্ত্রীরা আছেন, আছেন ভাই-ভাইপোরাও। সততার প্রতীকের রাজত্বে এই ক’বছরে কার কত সম্পত্তি হলো তা থেকেই আস্ফালনের কারণ বোঝা যায়। ৩৪বছরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের ভাই-ভাইপোদের এমন হয়েছিল নাকি?

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেও আমরা বলেছিলাম, সিঙ্গুরের বিবাদ আমরা মেটানোর পক্ষে। আমরা চেয়েছিলাম কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করেই সিঙ্গুর-শালবনী-রঘুনাথপুরে শিল্প হবে। নির্বাচনে যে ২কোটি ১৫ লক্ষ মানুষ তৃণমূল-বি জে পি-র বিরুদ্ধে ভোট দিলেন, তাঁরা তো এসব জেনেবুঝে ভেবেই ভোট দিয়েছেন। এই নির্বাচন প্রকৃত অর্থে সর্বত্র অবাধ হলে এবং ৪শতাংশ ভোট এদিক-ওদিক হলে ফলাফল কী হতো তা বলা যায় না।

এখন মুখ্যমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের রায় পেয়ে উৎসবে মেতে আছেন। আপনি জমি জরিপের কাজ শুরু করে দিন, তবে মানবজমিনের কথাটাও মাথায় রাখবেন। সিঙ্গুরের যেসব যুবকযুবতী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে কারখানায় কাজে যোগ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁদের কী হবে? তাঁদের কাছে কী কৈফিয়ৎ দেবেন? সিঙ্গুরের জমির কতটা চাষযোগ্য করে দেবেন? যেটা চাষযোগ্য নয়, সেটার কী করবেন? জমি না হয় দিলেন, কিন্তু যারা ফেরৎ পেলো তাঁদের আয় ও কর্মসংস্থানের সমাধান কীভাবে করবেন? ফেরৎ পাওয়া জমি শেষপর্যন্ত কৃষকদের হাতে থাকবে তো? নাকি সিঙ্গুর উৎসবের উদ্যোক্তাদের হাতে চলে যাবে? অথবা তাঁদের মাধ্যমে অন্য কোথাও হস্তান্তরিত হয়ে যাবে? আপনি যতই উৎসব করুন, আপনার এখনো অনেক দূর যাওয়া বাকি। হ্যাঁ, উৎসবের মরশুম আসছে। ঈদ আসছে, শারদোৎসব আসছে। কিন্তু সরকারের উৎসব করা সাজে না। বাংলার যন্ত্রণাক্লিষ্ট সাধারণ মানুষ যে সরকারের উৎসবে মেতে ওঠার মেজাজে নেই, তা ২রা সেপ্টেম্বরেই আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। অতএব, ধীরে, রজনী ধীরে।

আর যারা এখন ভোল বদলাচ্ছেন, তাঁদের বলি, সাধু সাবধান।


গণশক্তি, ৪ঠা সেপ্টেম্বর, রবিবার, ২০১৬

No comments:

Post a Comment